কলকাতার নিউ টাউনের অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের প্রকৃত কারণ জানতে শাহীনের বক্তব্য জানা এই মুহুর্তে খুবই জরুরি মনে করছেন তদন্তকারী সংস্থাগুলো। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাইবে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয়রাও একমত, আনারকে হত্যা করার মতো সাহস কখনোই শাহীনের হবে না। কারণ আনারের কাছে শাহীনকে চুনোপুঁটি মনে করেন তারা। এ কারণে শাহীন গ্রেপ্তার না হলে প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড কে, তা নিয়ে ধূ¤্রজাল থেকেই যাবে। তাছাড়া এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে অনেকের নাম পাওয়া যাচ্ছে।
আনার হত্যাকান্ডে যাকে পরিকল্পনাকারী বলা হচ্ছে, সেই আক্তারুজ্জামান শাহীন ঘটনার আগেই পাঁচ দফায় আড়াই কোটি টাকা দিয়েছিলেন খুনিদের। এই টাকা নিয়েছেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। তিনি বাকি খুনিদের টাকা ভাগ করে দিয়েছেন। হত্যাকান্ডর পর আরও টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তদন্তকারী সংস্থা গুলোর কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। খুনিদের দেওয়া নগদ এই টাকা কীভাবে খরচ করা হয়েছে, সে বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে তদন্তকারী সংস্থা গুলো। আনার হত্যাকান্ডটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও কলকাতা পুলিশ। বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া শিমুল ভূঁইয়াসহ তিনজনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদ হাওলাদারকেও রিমান্ডে নিয়েছে কলকাতা পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। জিহাদ হাওলাদারের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তার তথ্য অনুযায়ী, এমপি আনারকে হত্যা করার পর মরদেহ ৮০ টুকরো করা হয়। টুকরোগুলো ছোট পলিথিনে রাখা হয়। কিছু মাংস কিমা করা হয়। মাথা দুই ভাগ করে কিমার মতো করা হয়। সেসব বাথরুমের কমোডে ফেলা হয়। বাকিগুলো খাল বা অন্য কোনো জলাশয়ে ফেলা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তারা ছয়টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। সেগুলো হচ্ছে আনার কেন একা গেলেন, সীমান্ত অতিক্রম করার সময় তার এক মিনিটের ভিডিওটি কে করেছে, আনারের কাছে শুধু একটি ছোট ব্যাগ ছিল কেন, কলকাতা যাওয়ার সময় তিনি কী ধরনের গাড়িতে করে গেছেন, ওই সময় গাড়িতে আর কে ছিল এবং গোপাল নামে যে বন্ধু আছেন, তার সঙ্গে কী বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে? এ বিষয় গুলো জানার চেষ্টা করছেন তারা। পুলিশ সূত্র জানায়, কলকাতা থেকে আসা সিআইডির ৪ সদস্য ডিবির হেফাজতে থাকা তিন আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কলকাতায় আটক হওয়া দুজনের কাছ থেকে যে ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন তারা। হত্যাকান্ডর অন্যতম আসামি আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। শিমুল কলকাতার পুলিশ সদস্যদের জানিয়েছেন, অর্থের বিনিময়ে আনারকে হত্যা করা হয়েছে। পাওনা টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেই তাকে ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। শিলাস্তি রহমানকেও ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। শিলাস্তিকে দিয়ে আনারের আপত্তিকর ছবি তোলা হয়েছে। খুন করার পরিকল্পনা করেই আনারকে তারা কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে বালিশচাপা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। আনারকে হত্যার সময় ওই কক্ষে তার সঙ্গে ফয়সাল, মুস্তাফিজুর, সিয়াম জিহাদসহ আরও কয়েকজন ছিল। প্রথমে লাশ গুমের জন্য হাড়-মাংস আলাদা করা হয়। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পর কলকাতা পুলিশের প্রতিনিধি দলটি শনিবার চলে গেছে।
জড়িতদের মধ্যে শিমুল ছাড়া ফয়সাল আলী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা ৮ দিনের রিমান্ডে আছেন। পশ্চিমবঙ্গে কসাই জিহাদ গ্রেপ্তার হলেও সিয়াম ও মুস্তাফিজুর রহমানকে আটক করা যায়নি। জুবের নামের এক ট্যাক্সিক্যাব চালকে কলকাতা সিআইডি আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মুম্বাই থেকে ভাড়া করা কসাই বাংলাদেশের খুলনার বাসিন্দা জিহাদ ১২ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আনার হত্যাকান্ডটি ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে বাস্তবায়ত হওয়ায় অনেক তথ্য পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, এযাবৎ তথ্যে তাদের ধারণা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর সীমান্ত কেন্দ্রিক সোনা চোরাচালান, মাদক ও হুন্ডি কারবারের নিয়ন্ত্রণ; আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। খুনের প্রকৃত কারণ জানতে শাহীনের বক্তব্য জানা জরুরি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আনার হত্যার অনেক মোটিভ থাকতে পারে। পূর্ব শত্রুতার জের, আর্থিক লেনদেন, রাজনৈতিক বিষয়ও থাকতে পারে। এসব বিষয় জানতে তদন্ত চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই হত্যাকান্ড যারা বাস্তবায়ন করেছে, তারা সবাই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি হত্যাকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। ওই সব খুন করা হয়েছে গলা কেটে’।