করোনাকালীন সময়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কি অবস্থা, শিক্ষার্থীদের কি পরিমান ক্ষতি হচ্ছে, অনলাইন ক্লাস, এ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীদের কি উপকারে আসছে। শিক্ষার্থীদের জমাকৃত এ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষকগণ কিভাবে মূল্যায়ন করছেন, স্কুল কলেজ মাদ্রসা বন্ধ রয়েছে গত বছর ১৭ মার্চে থেকে কিন্তু দেদারসে চলছে শিক্ষকদের প্রাইভেট, কোচিং বানিজ্য, রহস্যজনক কারণে প্রশাসন রয়েছে নিরব দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু কোনা কোন স্থানে এসব অবৈধ প্রাইভেট কোচিং বানিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন প্রশাসন যা পত্র পত্রিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর পাওযা গেছে। এ অবস্থায় অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের কতটা উপকারে এসেছে। স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেটের গতি নিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা কতটা সমস্যার মুখে পড়েছে। এ সম্পর্কে লিখার জন্য, তথ্য উপাত্ত নিয়ে ল্যাপটপ ওপেন করলাম। এমন সময় জানা গেল রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার গোদাগাড়ী সরকারি স্কুল এ- কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ এনামুল হক এবং গোদাগাড়ী মহিলা ডিগ্রী কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমেনা খাতুন দাম্পতির বাড়ীতে একজোড়া বুলবুলি বাসা বেঁধেছে। বাড়ির বারান্দায় একটি ক্রিসমাস্ক ট্রির মধ্যখানে বাসা বেধে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এবং ৪ বার বাচ্চাও ফুটিয়েছে। এখন রয়েছে তিনটি ফুটফুটে বাচ্ছা। অবসারপ্রাপ্ত দাম্পতি বুলবুলি গুলির সাথে ভালই সময় কাটাচ্ছেন। বাড়িতে অতিথি আসলেও পাখি গুলি ভয় পায় না। সবাই বেশ মজা করে ছবি তুলে, ভিডিও করে ফেসবুকে পোষ্ট করেন। লিখেন অনেক সুন্দর সুন্দর কথা। এমন সময় ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে ওই বুলবুলির বাচ্চা, বুলবুলির ছবি পাঠান অধ্যক্ষ মোঃ এনামুল হক সাহেব।
তাই লিখার থিম পরিবর্তন করে বুলবুলি সম্পর্কে আল্লাহর নাম নিয়ে লিখা শুরু করলাম। জানি না পাঠকগণ কতটা আনন্দ পাবেন।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে বলেছেন-‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস নে আজি দোল’। আর শিশুরা মহানন্দে ছড়া কাটে-
বুলবুলি গো বুলবুলি
আয় না খেলি চুল খুলি।
গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থেকে
উদাস করিস আমায় ডেকে।
তোর গলার মিষ্টি সুরে
মন যে আমার কেমন করে।
আয় না কাছে বুলবুলি
গল্প করি মন খুলি।
বাংলায় বুলবুলি, বুলবুলির ইংরেজি নাম জঊউঠঊঘঞঊউ ইটখইটখ ড়ৎ ঈঙগগঙঘ ইটখইটখ (রেডভেন্টেড বুলবুল বা কমন বুলবুল)। বৈজ্ঞানিক নাম: চুপহড়হড়ঃঁং পধভবৎ) লালপুচ্ছ বুলবুলি বা কালচে বুলবুলি চুপহড়হড়ঃরফধব (পাইকনোনোটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত চুপহড়হড়ঃঁং (পাইকনোনোটাস) গণের এক প্রজাতির অতি পরিচিত দুঃসাহসী এক পাখি। বুলবুলি হিসেবে এরা সুপরিচিত। পাখিটি পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয়।
বুলবুলি আমাদের অতি পরিচিত পাখি। আমাদের কাছের পাখিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ওদের বসবাস মানুষজনের গা ঘেঁষে। তাই ঢাকা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের যে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তরে এই পাখির সঙ্গে আমাদের দেখা হয় হরহামেশাই।
গেরস্থ বাড়ির উঠোন কিংবা বাগানে স্বাধীনাভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ওদের। দেখা যায় শহুরে বাড়ির আশপাশেও। আমাদের দেশে এমন কোনো বাগান নেই যেখানে বুলবুলি দেখা যায় না। ওরা গভীর অরণ্য পছন্দ করে না মোটেও। থাকছে পছন্দ করে মানুষের খুব কাছে।
স্ত্রী-পুরুষ একই রকম দেখতে। মাথা ও গলা চকচকে কালো। ওদের মাথার ওপর ছোট্ট কালো ঝুঁটি আছে। ঝুঁটিটি দেখলে মনে হয় যেন চুলে কদম ছাঁট দেয়া হয়েছে। কারো কারো আবার ঝুঁটি দেখা যায় না।
সারা শরীর এবং ডানা পাটকিলে রঙের। ডানা, পিঠের ওপরের অংশ ও বুকের প্রতিটি পালকের আগায় খুব সরু সাদা পট্টি নজরে পড়ে। লেজের ডগা পাটকিলে। এই পাটকিলে রঙ গাঢ় হয়ে এসে শেষপ্রান্তে সাদা। তল পেট ও লেজের তলের অংশ ফিকে সাদা। ডানারও কতোগুলো পালকের প্রান্তদেশ সাদা। তলপেটের শেষে লেজের তলা টুকটুকে লাল। চোখের ভেতরের অংশ গাঢ় পিঙ্গল। চঞ্চু ও পায়ের রঙ কুচকুচে কালো। চঞ্চু ছোট ও শক্ত।
বুলবুলিদের খাবার মেন্যুতে আছে বিভিন্ন রকম ছোট ছোট ফল, কিট-পতঙ্গ এবং ফুলের মধু। পুঁইশাকের পাকা দানা ও মটরশুটি ওদের খুব প্রিয় খাবার। তাই কৃষকের ভরা জমিতে এসব সবজি খেতে ওদের দলে দলে হামলা করতে দেখা যায়। তাল-খেজুরের রসও ওদের বেশ প্রিয়। শীতকালে খেজুর গাছে ঝোলানো রসের হাঁড়িতে বসে প্রায়ই আরাম করে রস চুরি করে খেতে পছন্দ করে ওরা।
সামাজিক পাখি বুলবুলি। তাই জোড়ায় জোড়ায় বা দল বেঁধে চলতে পছন্দ করে ওরা। ওদের ভালোবাসা বেশ গভীর। জোড়া ছাড়া ওদের দেখা যায় না বললেই চলে। বেলা শেষের গোধূলি লগনে বাগানের কোনো ঝাঁকড়া গাছে বা পুকুর পাড়ের কোনো ঝোপের মধ্যে এক সঙ্গে হয়ে কিচিরমিচির শব্দে ওরা পাড়া মাতিয়ে তোলে।
গোদাগাড়ী পৌরসভার গোদাগাড়ী সরকারি স্কুল এ- কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ এনামুল হক বলেন, আমার বাসায় এরা স্থায়ীভাবে বসবস শুরু করেছে। আমাদের পরিবারের সদস্যদের শুধু নয় অতিথি আসলেও তারা ভয় পায় না। এ পর্যন্ত চার বার ডিম দিযে বাচ্চা ফুটিয়েছে। প্রতিবার ২/৩ টি ডিম পাড়ে, কোন সময় ১ টি বাচ্চা মারা যায়, একবার দুটি ফেুটে একটি বাচ্চা মারা যায়, গন্ধ হওয়র ভযে সেটি সরিয়ে ফেলি কিন্তু বুলবুলি গুলি ওই বচ্চাটির সেবা, খাবার কম দেয়, আমি আমার স্ত্রী ওই বাচ্চটি নিয়মিত খাবার দিয়ে বড় করে তুলি পড়ে ছেড়ে দি। ওই পাখি প্রেমিক আরও বলেন, আমার বাড়ী পাশে আম বাগানে
শেষ বিকেলে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি বুলবুলিকে আমি দল বেঁধে এভাবে খেলতে দেখেছি বহুবার। বাগানটি সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আমি ওদের খেলা দেখেছি মুগ্ধ দৃষ্টিতে। তিনি আরও বুলবুলি খুবই চঞ্চল স্বভাবের পাখি। স্থির হয়ে যেন বসতেই পারে না। তার ওপর আবার বেশ ঝগড়াটে এবং লড়াইবাজও বটে। এ কারণে একসময় সারা ভারতবর্ষে বুলবুলি পালার রেওয়াজ ছিলো। বাংলাদেশেও একসময় কক ফাইটের মতো বুলবুলিরও লড়াই দেখা যেতো। এখন ওসব আর চোখে পরে না।
বুলবুলি বেশ সাহসী পাখি। শত্রুর দেখা পেলে তাকে ছেড়ে কথা কয় না। শক্ত নখর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ওপর। এই পাখি আবার বেশ ভালোভাবে পোষ মানে। হয় প্রভু ভক্ত।
উত্তরা ব্যাংক, মহিশালবাড়ী বাজার শাখার ম্যনেজার মোঃ আমিনুল ইসলাম জানান, আমি অধ্যক্ষ সাহেবে বাসায় আমি গিয়েছিলাম। বুলবুলি ৩ টি বাচ্চা নিয়ে বসে আছে, খুব সুন্দর লাগছে, আমি ছবি তুলেছি। ছবি তোলার সময় মা বুলবুলিটি প্রথমে পালিয়ে যায়, কিছু পরে আবার আসে তখন সুন্দরভাবে ছবি তুলি, ভিডিও করি।
ফাইয়াজ ইসলাম ফাহিমের বুলবুলি নিয়ে কবিতা
বুলবুলি আমার বুলবুলি
কবে তুই আমার হবি
ও বুলবুলি
ও আমার বুলবুলি।
.
তোর রূপের নেশায় হইছি আগুন
ভালবেসে কররে আমায় আদর
করে দে আমায় খুন
ও বলুবুলি ও আমার বুলবুলি।
.
তোর ঐ নরম নরম
শরম শরম গা,
একটু আমায় ছুঁইতে দে
আমার সবকিছু দিবো যা তুই নিয়ে যা
ও বুলবুলি ও আমার বুলবুলি।
.
তোর সনে বাসর করবো এই মধু রাতে
চুমায় চুমায় ভালবাসা মাখবো
তুই ছাড়া কেউ থাকবে আমার সাথে
ও বুলবুলি ও আমার বুলবুলি।
আরও একটি কবিতায় দেখা যায়,
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে
দূর দূর বনের গান,
নীল নীল নদীর গান
দুধভাত দেব সন্দেশ মাখিয়ে।
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে।
ঝিলমিল ঝিলমিল ঝর্ণা যেথায়
কুলকুল কুলকুল রোজ বয়ে যায়
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী গল্প শোনায়
রাজার কুমার পক্ষীরাজ চড়ে যায়।
ভোরবেলা পাখনা মেলে দিয়ে তোরা,
এলি কি বল না সেই দেশ বেড়িয়ে ?
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে।
কোন গাছে কোথায় বাসা তোদের ?
ছোট্ট কি বাচ্চা আছে তোদের ?
দিবি কি আমায় দুটো তাদের ?
আদর করে আমি পুষবো তাদের।
সোনার খাঁচায় রেখে ফল দেবো খেতে
রাধে কৃষ্ণ নাম দেব শুনিয়ে।
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে
দূর দূর বনের গান,
নীল নীল নদীর গান
দুধভাত দেব সন্দেশ মাখিয়ে।
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে।
বুলবুলি পাখি সুন্দরভাবে পোষ মানে, ওরা একখান থেকে ওরা অন্য খানে যেতে চাই না। বুলবুলি খুব ভালো উড়তে পারে না বলে একটানা বেশি দূর উড়ে যায় না। তবে ওদের ওড়াটা বেশ দ্রুত। ওড়ার সময় ডানার ঝাপটার শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। ওড়াউড়ি করার চেয়ে সারাক্ষণ ওরা গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াতেই অভ্যস্ত। মাটিতে ভালো করে হাঁটতে পারে না বলে মাটিতে নামে না বললেই চললে। কোনো খাবার মাটি থেকে তুলে নেয়ার প্রয়োজন হলেই কেবল মাটিতে নেমে আসে।
বুলবুলির গলার আওয়াজ বেশ আকর্ষণীয় ও স্পষ্ট। ওরা গান গায় না। তবে সারাদিনই বিরামহীনভাবে মিষ্টি এবং সুরেলা কণ্ঠে ডাকাডাকি করে ঘুরে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে।
ওদের প্রজননকাল বর্ষা মৌসুম। এ সময় কোনো ঝোপ বা ছোট গাছের ডালে শুকনো ঘাসের গোড়া, চুল, শুকনো পাতা বা গাছের ছাল দিয়ে বাসা তৈরি করে। বাসাটি দেখতে বাটির মতো। এ বাসায় ২ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ গোলাপি সাদা; তার ওপর বাদামির ছোপ থাকে। ডিম ফোটানো এবং বাচ্চা প্রতিপালনের কাজ পুরুষ স্ত্রী দুজনে মিলেই করে।
কাক, চড়ুই, শালিকের মতো বুলবুলিও আমাদের আঙিনার পাখি। আমরা সকালে ঘুম ভেঙে উঠে বাড়ির উঠোনের গাছে গাছে বুলবুলির নাচন দেখে মুগ্ধ হই। আমাদের প্রকৃতিতে ওরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। এ দেশে ওরা বেশ ভালোই আছে।
শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত দেশে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বুলবুলি পাখি চেনে না। শিল্প-সাহিত্য-কবিতা-গান-ছড়ায় সেই আদি যুগ থেকে বার বার উঠে এসেছে এই পাখির নাম। আসুন আমরা সবাই পাখিদের ভালবাসি, পাখি শিকারীদের সচেতন করি।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা