ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তাদের ভরণপোষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমেই কমে আসছে। ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকতে থাকতে রোহিঙ্গারাও ক্রমে বেশি করে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। প্রভাব বিস্তার ও উপদলীয় কোন্দলে প্রায়ই খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিছু রোহিঙ্গা নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেছে। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের বিষয়টি বাংলাদেশের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগও ফলপ্রসূ হচ্ছে না। প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমার কার্যত কিছুই করছে না। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার বাংলাদেশে সাময়িকভাবে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে জোর দিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ। জেনেভায় পরিষদের ৫৬তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করা এবং তাদের জোরপূর্বক বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে যুদ্ধরত সব পক্ষকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়া এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধসহ সব ধরনের নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার আওতায় আনা ও তদন্ত প্রক্রিয়া জোরদার করার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, আশপাশের দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা সমুদ্রপথে অবৈধভাবে অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালানসহ নানা ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই আরো তীব্র ও জটিল আকার ধারণ করছে। এজন্য ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা, আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়া এবং প্রত্যাবাসনে অচলাবস্থা-মূলত এই তিনটি কারণকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে জাতিসংঘের মানবিক আবেদনে মাত্র ৬৩ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে। আর ২০২৩ সালে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি আরো কমেছে। আমরা মনে করি, প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমারের ওপর আরো বেশি চাপ সৃষ্টি করতে হবে। টেকনাফ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে অন্যান্য দেশকেও এগিয়ে আসতে হবে।