বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলকে ফ্যাসিস্ট বলায় উপাচার্যকে প্রকাশ্যে সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলেছেন শিক্ষক সমাজ। সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ববি’র সাম্প্রতিক অনাকাঙ্খিত ঘটনাবলির বিষয়ে শিক্ষক সমাজের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পাঠকালে শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সরকার উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিনকে ফ্যাসিস্ট শক্তির একজন চিহ্নিত দোসর বলে আখ্যায়িত করেন। অপরদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নামে থানায় দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আল্টিমেটামের ছয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও মামলা প্রত্যাহার না করায় মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা।
এর আগে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন বলেছেন, শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলনে ঘটা ঘটনাগুলো জুলাই আন্দোলনের সময়েও ঘটেনি। বিষয়গুলো ঘটনো হচ্ছে, আমরা নির্দিষ্ট কোন কারণই পাইনি যে তারা তালা দিবে। পরেও তারা এমন কোন কারণ বলতে পারেনি যার ফলশ্রুতিতে এমন ঘটনা ঘটানো যায়। এই ধরণের ঘটনাগুলো ঘটানোর পেছনে তিনজন মানুষ আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের প্রবেশ গেট ভাঙচুরের অভিযোগে ৪২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রোববার বরিশাল বন্দর থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার কেএম সানোয়ার পারভেজ লিটন। মামলায় প্রধান সাক্ষী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। এছাড়াও সহকারী প্রক্টর মারুফা আক্তার, সাইফুল ইসলাম, ড. সোনিয়া খান সনি, ইলিয়াস হোসেন মামলার সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে বেআইনি জনতা বদ্ধে অনধিকার প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন ও খুন জখমের হুমকি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার বরাতে বরিশাল বন্দর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭তম সিন্ডিকেট সভা ছিল। সভাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও কর্মচারীদের মদদে কিছু ছাত্র নামধারী আসামি বহিরাগত অজ্ঞাতনামারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে। তারা লাঠি, লোহার রড, ইটপাটকেল ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে উপাচার্যের গেট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে। পরে তারা হুমকিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। এছাড়াও এজাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. গোলাম রাব্বানী, ট্রেজারার মামুন-অর রশিদ ও ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিন সিন্ডিকেট সভা বয়কট করে অসহযোগিতা করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি পূরণে ১২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়িয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শুচিতা শারমিন সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশকে তথ্য দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সব ঘটনার তদন্ত করছেন।
পাশাপাশি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন উপচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৬ ফেব্রুয়ারি ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ভিসি বলেন, আমি এখানে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যানের জন্য। প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়গুলো সম্পর্কে গ্যাপ তৈরির চেষ্টা চলেছে। জুলাই আন্দোলনের পরে আমরা যারা বিভিন্ন জায়গাতে এসেছি, তাদের বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সমস্যায় ফেলা হচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করতে এই কাজগুলো অত্যন্ত অনুচিত হচ্ছে। প্রো-ভিসিকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া এবং প্রো-ভিসির ডাকা মিটিং এ চেয়ারম্যানদের যেতে না দেয়ার নোটিশ জারির বিষয়ে ড. শুচিতা শরমিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রো-ভিসি (অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী)। এরআগে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রো-ভিসি ছিলেন না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যদি ভিসি কাজ না দেয়, তাহলে প্রো-ভিসির কোন কাজ নেই। আমি প্রথমে ওনাকে ধৈর্য্য ধরতে বলেছিলাম, সেইসাথে কাজ দেয়ারও চেষ্টা করছিলাম। ইউজিসির সাথে কথা বলে ওনাকে কি কি সুবিধা দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু প্রো-ভিসি ধৈষ্য না ধরে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতীশীল করে তুলেছেন।
ভিসি আরও বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত, সেইসময় থেকে এ পর্যন্ত যারা নিয়োগ পেয়েছেন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং যারা শিক্ষার্থী তারা সবাই ফ্যাসিষ্ট আমলের। এ পর্যন্ত নতুন কেউ যোগদান করেনি এবং কেউ যদি বলে আমি ফ্যাসিস্টের কেউ নই, সেটা দাবি করতে পারবে না।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে ভিসি বলেন, যে ঘটনা জুলাই আন্দোলনেও হয়নি, এবার তার চেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাইস চেয়ারম্যানের বাংলোর শুধু গেট ভাঙ্গা হয়েছে এমন নয়, কলাপসিবল গেটের ভেতরেও ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছে। এসব ভাঙচুরের কারণ কি? অপরদিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে মশাল মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উপাচার্য (ভিসি) ড. শুচিতা শরমিন তার বাসভবনে আওয়ামী দোসর শিক্ষকদের নিয়ে গোপন বৈঠক করেছেন। আমরা প্রশাসন বরাবর আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পূর্নবাসন চলমান যৌক্তিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ের করা ষড়যন্ত্রমূলক হয়রানি মামলা প্রত্যাহারের দাবি করছি।
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলকে ফ্যাসিস্ট বলায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর কাছে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলেছেন শিক্ষক সমাজ। সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠকালে শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সরকার বলেন, উপাচার্য গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীকে ফ্যাসিস্ট বলে গালি দিয়েছেন। অথচ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যেখানে বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে পুলিশ ও সেনা বাহিনীকে প্রথম প্রতিহত করে বিজয় অর্জন করেছিল। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সরকার আরও বলেন, আমরা প্রমাণ সহকারে জানি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন নিজে ছিলেন ফ্যাসিস্ট শক্তির একজন চিহ্নিত দোসর। এমন চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলকে ফ্যাসিস্ট বলেছেন, এর চেয়ে লজ্জা ও ঘৃণার কিছু হতে পারে না। সবমিলিয়ে গত কয়েকদিন ধরে চলা অনাকাঙ্খিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।