নওগাঁর মহাদেবপুরে একের পর এক বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা থেকে গাছ চুরি হচ্ছে। স্থানীয়রা গাছ চোরদের শনাক্ত করে প্রশাসনকে জানালেও প্রমাণ পাবার পরও এদের বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জনমনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। গাছ চোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রকাশ্যে সরকারি মদদেই গাছ কাটার উৎসব শুরু হয়েছে এলাকার বিভিন্ন স্থানে।
স্থানীয়দের অভিযোগ উপজেলার আত্রাই নদীর দুধার দিয়ে, বিভিন্ন খাল ও খাড়ির পাড় দিয়ে, বিভিন্ন সরকারি রাস্তার দুধারে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কবরস্থান, মন্দির, পীরপাল ও দেবোত্তর সম্পত্তি এবং খাস খতিয়ানভূক্ত সম্পত্তিতে রোপিত অসংখ্য গাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে এক শ্রেণির গাছ চোর রীতিমত সিন্ডিকেট তৈরি করে প্রকাশ্য দিবালোকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। গাছ কাটার সময় প্রশাসনকে খবর দেয়া হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কোনই পদক্ষেপ নেননা। কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছ আটক করলেও অজ্ঞাত কারণে চোর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা নেননা। স্থানীয়রা বলছেন, গোপন আঁতাতের ফলেই চোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়না। ঘটনার পরে গোপন লেনদেনের মাধ্যমে এসব মিমাংশা করা হয়। এছাড়া অনেক সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোপিত গাছ অপসারণের নির্ধারিত বিধি অনুসরণ না করেই ইচ্ছামতই গাছ কাটা হচ্ছে। ফলে এসব গাছ বিক্রির টাকা থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। বাড়ছে অনিয়ম।
গতবছর ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উপজেলার মহাদেবপুর-মাতাজীহাট সড়কে রোপিত ৫টি গাছ কেটে চোরেরা উপজেলা সদরের একটি স মিলে বিক্রি করতে আনে। জানতে পেরে বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রিয় ফেসবুক আইডি মহাদেবপুর দর্পণ থেকে লাইভ সম্প্রচার করা হয়। এর পরই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আরিফুজ্জামান, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিএমডিএ মহাদেবপুর জোনের সহকারি প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি আমিনুল হক প্রমুখ ঘটনাস্থলে এসে চুরি হওয়া গাছ ও চোরদের শনাক্ত করে গাছগুলো জব্দ করেন। গাছ চোর হিসেবে উপজেলার সদর ইউনিয়নের সরমইল গ্রামের আবুল কাশেম, তার ছেলে সায়েদ আলী ও খোশালপুর গ্রামের আসলাম আলীকে শনাক্ত করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোথাও কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি, চোরদেরও ব্যবস্থা হয়নি। জানতে চাইলে বিএমডিএ মহাদেবপুর জোনের সহকারি প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন জানান, গাছগুলো জব্দ করে তার অফিসে নিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কি কারণে থানায় মামলা হয়নি, অথবা চোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তা তিনি জানাতে পারেননি।
গত ২৪ জানুয়ারি সকাল থেকে মহাদেবপুর উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স চত্ত্বরের কমপক্ষে ৬টি বিভিন্ন জাতের বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। যেকোন সরকারি স্থাপনা থেকে গাছ কাটতে হলে সেবিষয়ে যে অনুমোদনের প্রয়োজন হয় এক্ষেত্রে তা নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি জমির গাছ কাটার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। ১৯২৭ সালের বন আইনে বন সংরক্ষণ ও গাছ কাটার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গাছ কাটার অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় ২০২৪ সালে নতুন আইন চালু করা হয়। এতে সরকারি বা ব্যক্তিগত যে কোন গাছ কাটার জন্য বন বিভাগের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জানতে চাইলে উপজেলা বন কর্মকর্তা ময়েন উদ্দিন জানান, ইউএনও অফিসে গাছ কাটার জন্য কোন অনুমোদন চাওয়া হয়নি। ইউএনও মো: আরিফুজ্জামান জানান, জরুরী ভিত্তিতে গাছগুলো কাটা হয়েছে জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। গাছগুলো পরে নিলামে বিক্রি করা হবে। কিন্তু এর দেড় মাস পর গত ১২ ফেব্রুয়ারি উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে কাটা গাছগুলোর মধ্যে কয়েকটি গুল পাওয়া যায় উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের কুঞ্জবন রঘুনাথজিউ মন্দিরের সামনে। তার পাশেই সরকারি প্রকল্পের বাড়িতে বসবাস করা উপজেলা পরিষদের ক্লিনার বিশাল বাঁশফোড় জানান, গাছগুলো তিনিই নিয়ে এসেছেন রান্নার খড়ি করার জন্য। বিষয়টি ইউএনওকে জানানো হলেও এর বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে উপজেলার চাঁন্দাশ ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন ভবনের পাশে দীর্ঘদিন আগে লাগানো লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ২টি মেহগনি গাছ প্রকাশ্য দিবালোকে কেটে স মিলে বিক্রি করে দেয়া হয়। এব্যাপারে ওই ইউপির সাবেক মেম্বার আব্দুর রহিম বাদি হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মহাদেবপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এব্যাপারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতা আব্দুল্লাহ আল হাসানকে দায়ি করা হয়। অভিযোগের পরে গাছগুলো ইউনিয়ন পরিষদে এনে জমা দেয়া হয়। কিন্তু এব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। জানতে চাইলে আব্দুল্লাহ আল হাসান জানান, গাছগুলো লাগানো হয়েছিল ব্যক্তি মালিকানার জায়গায়। তাই কাটা হয়েছিল। তদন্তের পর গাছগুলো ফেরৎ দেয়া হয়েছে। তদন্তে প্রমাণ হয়েছে যে, কোন অনিয়ম করা হয়নি। জানতে চাইলে মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহীন রেজা জানান, ঘটনার সময় তিনি মহাদেবপুরে কর্মরত ছিলেন না। তাই সে সম্পর্কে কিছু জানেন না। তবে এবিষয়ে কোন মামলা হয়নি।