একসময় যে ওষুধ মানবজাতিকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, আজ সেই জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকই হয়ে উঠছে ভয়াবহ এক বিপদের উৎস। অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ক্রমেই অকার্যকর হয়ে পড়ছে, যার ফলে পৃথিবীজুড়ে তৈরি হচ্ছে নতুন এক স্বাস্থ্য সংকটÑঅ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের ফলে বিশ্বজুড়ে ৩০ লাখেরও বেশি শিশু মারা গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিশুরা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা ভবিষ্যতে একটি নীরব মহামারির রূপ নিতে পারে। আর বাংলাদেশও এই ঝুঁকির বাইরে নয়Ñবরং এ দেশের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। দেশের জাতীয় জরিপ বলছে, কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ৮২ থেকে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। গড়ে প্রতিরোধের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালের আইসিইউতে লিনেজোলিড ও কার্বাপেনেমের মতো রিজার্ভ ক্যাটাগরির ওষুধ পর্যন্ত কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। অথচ এই ওষুধগুলো সাধারণ ওয়ার্ডেও অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভয়াবহ বিষয় হলো, রোগীদের অনেকেই অসচেতনভাবে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন, আবার অসাধু চিকিৎসকরা কোম্পানির স্বার্থে একাধিক অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক একসঙ্গে দিচ্ছেন। ফার্মেসিতে কোনো রকম প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক। এর বাইরে, গবাদিপশুর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করছে অপ্রত্যক্ষভাবে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ সর্দি-জ্বরেও মানুষ মারা যেতে পারে। কেননা, তখন কার্যকর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আর অবশিষ্ট থাকবে না। আমরা যে ওষুধগুলোকে শেষ আশ্রয় হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিলাম, সেগুলোও এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে। তখন চিকিৎসাবিজ্ঞান সামনে থাকবে, কিন্তু হাতে থাকবে না কার্যকর কোনো অস্ত্র। এই পরিস্থিতি শুধুই একটি দেশের সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক সংকট। তবে সমাধানের শুরু হতে পারে স্থানীয় পর্যায় থেকেই। আমাদের প্রয়োজন কঠোর নীতিনির্ধারণ, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগ। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। রিজার্ভ ক্যাটাগরির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে আনতে হবে কঠোর অনুমোদন ব্যবস্থা। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবেÑঅ্যান্টিবায়োটিক কোনো ম্যাজিক নয়, এটি একটি দায়িত্বশীল ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র। চিকিৎসক, রোগী, ফার্মেসি, ওষুধ কোম্পানি এবং রাষ্ট্রÑসব পক্ষের সম্মিলিত সচেতনতা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আজ যদি আমরা ভাবি, ‘এতে কীই বা হবে’, তবে কাল হয়তো আমাদের আর ভাবার সুযোগই থাকবে না। আমরা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকেই ধাবিত হচ্ছি, যেখানে মৃত্যু আসবে নিঃশব্দেÑস্রেফ ওষুধ কাজ না করার কারণে। এখনই সময়, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করে এই নীরব দুর্যোগকে রুখে দেওয়ার।