উৎসব মুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ

হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করেছে

এফএনএস (কেশব কুমার বড়ুয়া; হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) : | প্রকাশ: ৩০ মে, ২০২৫, ০৫:২১ পিএম
হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করেছে

প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে  গত বৃহস্পতিবার সকালে  মা মাছ ফের নমুনা ডিম ছেড়েছে। পরে রাত আড়াই পর থেকে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার প্রথম দফায় মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছে। সাগড়ে লঘু চাপের কারনে নদীতে পানির পরিমাণ আশংকা জনক ভাবে  বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেমে থেমে বৃষ্টি হালকা, মাঝারী ও ভারি বৃষ্টিপাত হয়। 

গত এপ্রিল মাসে আমাবস্যা ও পূর্ণিমার দুইটি তিথি চলে গেছে। তাছাড়া চলতি মে মাসে পূর্ণিমার একটি তিথি ও চলে গেছে। কিন্তু বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ও নদীতে ঢলের প্রকোপ না থাকায় মাছ ডিম ছাড়েনি  মাছ ।  এখন আমাবস্যা জো/ তিথি চলছে। চলমান এই  তিথিতে ও তেমন বজ্রসহ বৃষ্টিপাত না থাকলে ও  গত বৃহস্পতিবার   বিকাল থেকে   থেমে থেমে হালকা মাঝারি ও ভারি বর্ষন  অব্যাহত ছিল । বৃহস্পতিবার  বেলা এগারোটা ; সাড়ে এগারোটার দিকে হালদা নদীর গড়দুয়ারা নয়াহাট, সিপাহীর ঘাট, মাছুয়াঘোনা, আজিমারঘাট, ঝোরারমুখ, নাপিতেরঘাট, কুমারখালী, আমতুয়া কাগতিযার টেক সহ নদীর বিভিন্ন স্থানে নমুনা ডিম পাওয়া গেছে। নমুনা ডিমের আলামত পাওয়ার  খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ডিম সংগ্রহকারীরা নৌকা ও ডিম আহরনের সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে।  সাগড়ে নিন্ম চাপের প্রভাবে  নদীর পানি আশংকা ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মদুনাঘাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে  সকালে  নমুনা ডিম পরে রাতে মাছ ডিম ছাড়ার কথা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে বলেন সাগড়ে নিন্ম চাপের প্রভাবে নদীর পানি সীমহীন ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ মাদার্শা, মদুনাঘাট, উত্তর মাদার্শা গড়দুয়ারাসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর পানি ঢ়ুকে পড়েছে। এলাকার চলাচলের রাস্তা, বাড়ি ঘরের উঠানে নদীর পানি ঢ়ুকে পড়েছে। এই পানিতে লবনাক্তা রয়েছে বলে ও তিনি উল্লেখ করেন। লবনাক্ত পানিতে ছাড়া ডিম থেকে রেনু তেমন ফোটা না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ডিম সংগ্রহকারী গড়দুয়ারা কামাল সওদাগর জানান, বিভিন্ন স্থানে  নমুনা ডিম পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে বলেন, সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থাকলে মাছ ডিম ছাড়ে না। তবে বাতাসের তীব্রতায় নদীতে প্রবল ঢেউয়ের সৃষ্টি হলে অনেক সময় মাছ ডিম ছেড়ে দেয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি গত  বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার পর মা মাছ নদীতে ডিম দেওয়া শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন। তাই তারা সে সময় থেকে ডিম সংগ্রহ ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে বলে জানান।  ডিম ছাড়ার পরিমান আশানুরূপ  বলে  তিনি উল্লেখ করেন। তার ১০ টি নৌকায় প্রায় ৩৫ বালতি ডিম আহরন করেছে বলে তিনি জানান। বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৪০ মিনিট থেকে গতকাল শুক্রবার দুইটা পর্যন্ত ডিম ছেড়েছে বলে তিনি জানান। 

এবার হালদা নদী থেকে প্রায়  ২ হাজার বালতি ডিম সংগৃহীত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। যার আনুমানিক পরিমান প্রায় ২০ হাজার কেজি।   গত ২০২৪সালে সংগৃহীত ডিমের পরিমান ছিল ১৬৮০ কেজি 

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ২ টার পর জোয়ারের সময়  হালদা নদীর আমতুয়া অংশে কার্পজাতীয় মা মাছ পূরোদমে ডিম ছাড়ে। পরবর্তীতে ডিমগুলো হালদা নদীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যারা প্রথম দিকে ডিম সংগ্রহ করতে নদীতে ছিলো তারা অধিক ডিম সংগ্রহ করেছিলো। ডিম সংগ্রহকারীরা গড়ে দুই থেকে আড়াই  বালতি করে ডিম সংগ্রহ করেছে। কাঙ্ক্ষিত ডিম সংগ্রহ করতে পেরে ডিম সংগ্রহকারীরা ভীষণ আনন্দিত। বর্তমানে ডিম সংগ্রহকারীরা হ্যাচারী ও মাটির কূয়ায় ডিম ফুটানো কাজে ব্যস্ত।

 উল্লেখ্য গতকাল অমাবস্যার জোঁ বা তিথীতে (৪র্থ জোঁ) সকাল ১১ টার দিকে জোয়ারের সময় হালদা নদীর বিভিন্ন স্পনিং গ্রাউন্ডে দ্বিতীয় দফায় নমুনা ডিম ছাড়ে কার্পজাতীয় মা মাছ। প্রথম দিকে খুবই সামান্য পরিনাণে নমুনা ডিম পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে জোয়ার বাড়ার সাথে সাথে ডিমের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে থাকে। যেহেতু অমাবস্যার জোঁ চলছে তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলেই রাতেই পূরোদমে ডিম ছাড়ার ব্যাপক সম্ভাবনা ছিলো। ঠিক হয়েছে ও তাই।

হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড মঞ্জুরুল কিবরিয়া গতরাত ২টা থেকে বহুল প্রতীক্ষিত হালদা নদীতে রুই জাতীয় ব্রুট মাছ ডিম ছেড়েছে। নদীর পাড়ের প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ডিম সংগ্রহকারী ৩৫০-৪০০ শত নৌকা নিয়ে উৎসব সহকারে ডিম সংগ্রহ করছে। ভোরের দিকে একটু বৈরি আবহাওয়ায় স্বাভাবিক ডিম সংগ্রহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে  দুপুর ২ টা পর্যন্ত  কিছু ডিম সংগ্রহকারী ডিম সংগ্রহ করে.  তবে সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ হচ্ছে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবার ভালো পরিমান ডিম সংগৃহীত হয়েছে। মদুনা ঘাট ছায়ার চর থেকে, রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার গোনা, আজিমের ঘাট, মাচুয়া গোনা, কাগতিয়া, আইডিএফ হ্যাচারি,  সিপাহী ঘাট, নোয়াহাট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরিগোনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে অনেক ডিম সংগ্রহকারীরা খুবই খুশি। অনেকে প্রতি নৌকায় ৪/৫ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। এখন নদীর পাড়ে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারী এবং ট্রেডিশনাল মাটির কুয়াগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিমের পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। নদীতে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথ ভাবে ডিম সংগ্রহের তথ্য সংগ্রহ এবং নদীর সার্বিক পরিবেশ মনিটরিং করছে।

আমি মনে করি আজকের ডিম প্রাপ্তি হালদা নদী রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি ফসল। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনজিও আইডিএফ, এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সমন্বিতভাবে নিরলসভাবে কাজ করছে হালদা নদী রক্ষায়। হালদা নদী বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার একটি সফল উদাহরণ। 

ইতোমধ্যে সরকার সাতটি বিভাগের আটটি নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে হালদা নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হালদা  বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেখানে নদীর ৬০-৭০% ভাগ ইতিমধ্যেই দূষণমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। ভুজপুর রাবার ডেম নিয়ন্ত্রণ, মানিকছড়ির তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, পোল্ট্রি বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং কাটাখালি কৃষ্ণ খালি এবং খন্দকিয়া খালের দূষণ নিয়ন্ত্রন করতে পারলে শতভাগ দূষণমুক্ত করা সম্ভব হবে।  আমি আশা করছি বর্তমানের সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকলে প্রতিবছরেই হালদা নদীর ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং বর্তমানে সংরক্ষিত মৎস্য হেরিটেজ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে