সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

মহাদেবপুরে পাঠাগারের গ্রন্থাগারিকের অনৈতিক কর্মকান্ড

এফএনএস (রওশন জাহান; মহাদেবপুর, নওগাঁ) : | প্রকাশ: ৩ জুন, ২০২৫, ০৭:৪১ পিএম
মহাদেবপুরে পাঠাগারের গ্রন্থাগারিকের অনৈতিক  কর্মকান্ড

নওগাঁর মহাদেবপুরে উপজেলা কেন্দ্রীয় পাঠাগারের গ্রন্থাগারিকের নানান কুকীর্তি এখন সবার মুখে মুখে। যৌন কেলেঙ্কারি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, বিতর্কীতদের নিয়ে দফায় দফায় গোপন বৈঠক, চাঁদাবাজি প্রভৃতি অনৈতিক কাজের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তবে গ্রন্থাগারিক বলছেন তিনি নির্দোষ, আর কর্তৃপক্ষ বলছেন গ্রন্থাগারিক উপজেলা পরিষদের কোন কর্মচারিই নয়। এনিয়ে এলাকায় চলছে নানান গুঞ্জন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলা সমাজসেবা দপ্তর ১৯৯২ সালে “শিশু পাঠাগার স্থাপন প্রকল্প” গ্রহণ করে। প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স চত্ত্বরের পুরোনো ইউএনও অফিস ভবনের উত্তরে পুকুরপাড়ে একটি ঘরে পাঠাগারটি চালু করা হয়। আব্দুস ছালাম চৌধুরী নামে একজনকে সেসময় পাঠাগারটির গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দু’মাসের মাথায় তিনি পাঠাগারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে তদানিন্তন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা উপজেলার খাজুর গ্রামের লিয়াকত আলী বাবলুকে মাসিক ২৫০ টাকা সম্মানী ভাতায় গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগ দেন। অভিযোগ করা হয়েছে যে, দায়িত্ব পাবার পর থেকে লিয়াকত পাঠাগারের ঘরটিকে নানান অনৈতিক কাজের আখড়ায় পরিণত করেন। কৌশলে উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীদের পাঠাগারে ডেকে নানান প্রলোভন দিয়ে তাদের সাথে শারীরীক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এখানে একটি গ্রুপ প্রায়ই বৈঠক করে অনৈতিক কাজে জড়ান। তার কুকীর্তির কথা এলাকায় চাউর হলেও রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা নেননি কেউ। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রন্থাগারিক লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে এসব গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন হওয়ায় অভিভাবকেরা এনিয়ে শংকা প্রকাশ করেন। 

লিয়াকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, ফ্যাসিস্ট আমলে এখানে কবি সংগঠনের নামে বিতর্কীতদের সংগঠিত করা হয়। এছাড়া অন্য বিভিন্ন সংগঠনের অঘোষিত কার্যালয়ে পরিণত করা হয় এই পাঠাগারটিকে। ফলে পাঠাগারে কয়েক লক্ষ টাকার দেশী বিদেশী বইয়ের সম্ভার থাকলেও পাঠক নেই। কুটকৌশল হিসেবে গ্রন্থাগারিক যাদেরকে আমন্ত্রণ জানান, শুধু তারাই এখানে পাঠক হিসেবে এসে আড্ডা দেন। প্রতি কার্যদিবসে বিকেলে মাত্র দুই ঘন্টার জন্য পাঠাগারটি খোলা থাকার কথা থাকলেও প্রতিদিন সারাদিনই, এমনকি রাতেও এটি এমনিতেই খোলা রাখা হয়। মূলত: নানান অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্যই এমনটি করা হয়।

গতবছর ১৬ ডিসেম্বর উপজেলার বেহুলাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মহান বিজয় দিবস পালনের অনুষ্ঠানে দুজন শিক্ষিকা অনুপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে আইনুল হোসেন ও মোখলেছুর রহমান নামে দুজন ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন এবং এক লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করেন। প্রধান শিক্ষক মহাদেবপুর উপজেলা সদরে এলে ওই দুজনসহ বরুণ মজুমদার ও বিতর্কীত গ্রন্থাগারিক লিয়াকত আলী বাবলু তার কাছে আবার চাঁদা দাবি করেন। প্রধান শিক্ষক মুকুল চন্দ্র মন্ডল তাদেরকে পাঁচ হাজার টাকা দেন। কিন্তু ওই চার জন আরো টাকা চাইলে বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষক মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এর নিকট অভিযোগ দেন। গতবছর ১৮ ডিসেম্বর এনিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অভিযোগ করা হয় যে, চাঁদাবাজির এই পরিকল্পনা করা হয় পাঠাগারে বসেই এবং এতে নেতৃত্ব দেন গ্রন্থাগারিক নিজেই।

গত ২৮ মে ভোর থেকে পাঠাগারে পর পর তিন দফা গোপন বৈঠক করা হয়। এরপর উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে লিয়াকত আলী বাবলু ও অন্যরা স্থানীয় প্রশাসনের নানান অনিয়মের বিষয় উত্থাপন করেন। একজন গ্রন্থাগারিক কিভাবে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মত স্পর্শকাতর কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত থাকেন এবং উপজেলা পরিষদেরই কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের লোক পরিচয়ে বিভিন্ন দপ্তরে কাজ হাসিল করে নেয়া ও আধিপাত্য বিস্তারের অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে সুবিধা নেয়ারও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

২০১৬ সালে পাঠাগারের ভবন সংস্কার, অতিরিক্ত বই ও আসবাবপত্র ক্রয় ও পাঠাগারের পরিধি বৃদ্ধি করে একটি অতিরিক্ত মিলনায়তন তৈরি করা হয়। এটি বিভিন্ন সংগঠনের সভা, সেমিনারের জন্য প্রতিদিন দুই হাজার টাকা হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। গত নয় বছরে এ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা রাজস্ব আয় হয়। কিন্তু এর একটি টাকাও গ্রন্থাগারিক সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে সম্পূর্ণই আত্মসাৎ করেন।

জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রেজওয়ানুল হক নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানান, ১৯৯২ সালে শিশু পাঠাগার স্থাপন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। পাঁচ বছর পর এটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর থেকে তারা পাঠাগারটি আর পরিচালনা করেন না। কিন্তু লিয়কত আলী বাবলু নিয়ামানুযায়ী পাঠাগারটি বন্ধ না করে নতুন করে উপজেলা কেন্দ্রীয় পাঠাগার নামকরণ করে এখানে নানান অপকর্ম চালাতে থাকেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন জানান, উপজেলা কেন্দ্রীয় পাঠাগার নামে তাদের কাছে কোন ফাইল নেই। ইউএনও মো: আরিফুজ্জামান জানান, লিয়াকত আলী বাবলু উপজেলা পরিষদের কোন কর্মচারিই নন। পাঠাগারটি কিভাবে চলছে, মিলনায়তন ভাড়া দেয়া হয় কিনা, কথিত গ্রন্থাগারিকের যৌন কেলেঙ্কারিসহ নানান অপকর্মের বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান।

কোন বৈধ কর্মচারি না হয়েও কিভাবে বছরের পর বছর ধরে লক্ষ লক্ষ টাকার সরকারি সম্পদ কথিত গ্রন্থাগারিকের জিম্মায় আছে তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে তাকে অপসারণ করে, সরকারি বই, আসবাবপত্র ও মিলনায়তন ভাড়ার টাকার হিসাব বুঝে নেয়ার দাবি স্থানীয়দের। তারা পাঠাগারে নতুন গ্রন্থাগারিক নিয়োগ করে শিশুদের পাঠোপযুগি পরিবেশ সৃষ্টিরও দাবি জানান।

অভিযুক্ত লিয়াকত আলী বাবলু এসব ব্যাপারে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে জানান, গ্রন্থাগারিক হিসেব তার নিয়োগপত্র আছে। তিনি এখনও বিনা বেতনে সে দায়িত্ব পালন করছেন। মিলনায়তন ভাড়া তিনিই পাবেন বলেও দাবি করেন তিনি।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে