ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিমূলক বক্তব্যকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বুধবার (১৮ জুন) প্রকাশিত এক টেলিভিশন ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তার দেশ কাউকে যুদ্ধ কিংবা শান্তি চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেবে না। একইসঙ্গে মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণাম হিসেবে “অপূরণীয় ক্ষতির” হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বিবৃতিতে খামেনি বলেন, “যারা ইরান এবং এর ইতিহাস জানে, তারা কখনও হুমকির ভাষায় কথা বলে না। ইরানি জাতি আত্মসমর্পণ করবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমেরিকানদের জানা উচিত, যেকোনো ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ তাদের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হবে। এর মূল্য তারা কখনোই পরিশোধ করতে পারবে না।”
এই বক্তব্যটি আসে এমন এক সময়ে, যখন ইসরায়েল এবং ইরান টানা ছয়দিন ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে আকাশপথে হামলা ও পাল্টা হামলায় জড়িয়েছে। ইসরায়েল দাবি করছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, ইরান বারবার বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প একাধিক পোস্টে ইরানকে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ করতে বলেন। তিনি লিখেছেন, “আমরা জানি তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি একটি সহজ লক্ষ্য, তবে আমরা তাকে এখনই হত্যা করব না।”
এরপরই আরেকটি পোস্টে তিনি বড় অক্ষরে লেখেন, “UNCONDITIONAL SURRENDER” (নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ)। ট্রাম্পের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানের আকাশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং তারা ধৈর্যের সীমায় এসে পৌঁছেছে।
সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে জাতীয় নিরাপত্তা দলের বৈঠকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইরানের ফোর্ডো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রকে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি একটি পর্বতের নিচে প্রায় ৩০০ ফুট গভীরে অবস্থিত এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সুরক্ষিত। এই কেন্দ্রটিকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপযোগী স্থান হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
এ পর্যন্ত ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলি হামলায় তাদের অন্তত ২২৪ জন নাগরিক নিহত এবং এক হাজারের বেশি আহত হয়েছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে, ইরানের পাল্টা হামলায় তাদের ২৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, তেহরানে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান রাতভর বোমা বর্ষণ করলে হাজার হাজার মানুষ রাজধানী ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এদিকে ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে সাইরেন বেজে উঠেছে, যদিও হামলার মাত্রা আগের তুলনায় কম।
ট্রাম্পের হুমকির পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “মর্যাদাবান হায়দারের নামে, যুদ্ধ শুরু হলো।”
'হায়দার' ইসলামের চতুর্থ খলিফা ও শিয়া মুসলমানদের প্রথম ইমাম ইমাম আলীর (রা.) উপনাম। এই বার্তা থেকে ইরান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
একইসঙ্গে খামেনি জানিয়েছেন, “আমরা সন্ত্রাসী জায়নবাদী শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেব। জায়নবাদীদের কোনো দয়া দেখানো হবে না।”
সিবিএস নিউজ জানায়, ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে দাবি করছে তারা ইসরায়েলের হামলায় জড়িত নয়। তবে বিভিন্ন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা দিচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে।
আইএইএ (আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা) জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইরান অস্ত্র উপযোগী ইউরেনিয়ামের মজুদ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। যদিও বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ইরান তখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।