গ্রামীণ জনপদের উপজেলা হাসপাতালগুলোর সামনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলোর রমরমা ব্যবসার পেছনে রয়েছে রোগীদের টেস্টের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য করে এক শ্রেনীর অসাধু চিকিৎসকদের অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি টেস্ট থেকে চিকিৎসকেরা ৫০% করে কমিশন নিয়ে থাকেন। যেকারণে নামসর্বস্ত্র ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলোতে ওইসব চিকিৎসকেরা অভিনব পন্থায় গাণিতিক চিহ্ন দিয়ে টেস্টের জন্য রোগীদের পাঠাচ্ছেন। আর তাদের (চিকিৎসক) পছন্দের ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলো থেকে টেস্ট করা না হলে রোগীদের সাথে অসদ আচারনেরও অভিযোগ রয়েছে ওইসব অসাধু চিকিৎসকদের।
এবার এমনই এক অভিনব গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে টেস্ট বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হয়েছেন বরিশালের উত্তর জনপদের জনগুরুত্বরপূর্ণ (একমাত্র মহাসড়কের পাশ্ববর্তী) গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিরুজ্জামান।
তিনি অভিনব পদ্ধতিতে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের সাথে টেস্টের নামের পাশাপাশি উপরের এক কোনে গাণিতিক চিহ্ন লিখে দিচ্ছেন। ওই চিহ্ন দেখেই হাসপাতালের মধ্যে থাকা নির্দিষ্ট ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের দালালরা রোগীকে তাদের সেন্টারে নিয়ে টেস্ট করাচ্ছেন।
ওই গাণিতিক চিহ্ন ব্যতিত অন্যকোন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে চিকিৎসা করালে রোগীকে পরতে হয় ডা. মনিরুজ্জামানের রোষানলে। ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন ভুলভাল ওষুধ। এ অভিযোগ ডা. মনিরুজ্জামানের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের।
ডা. মনিরুজ্জামানের টেস্ট বাণিজ্যের অভিনব কৌশল এবং রোগীকে ভুলভাল ব্যবস্থাপত্র লিখে দেওয়া নিয়ে গত ৮ জুলাই দিবাগত রাতে গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া গ্রামের শাহাদাত মৃধা নামের এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট করেছেন। যা মুহুর্তের মধ্যে গৌরনদীতে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে।
ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ৯ জুলাই দিবাগত রাতে শাহাদাত মৃধা বলেন, জ্বরে আক্রান্ত আমার মামিকে নিয়ে গত ২ জুলাই উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যাই। নিয়মানুযায়ী টিকিট কেটে ডা. মনিরুজ্জামানের কক্ষে যাই। এসময় সে (মনির) বহির্বিভাগের রোগীর টিকিটের এক কোনে সাত নাম্বারের গাণিতিক চিহ্ন লিখে দিয়েছেন।
পরবর্তীতে ওই চিহ্ন দেখে হাসপাতালের অভ্যন্তরে থাকা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের দালাল আমার রোগীকে হাসপাতাল গেটের সামনে মেমোরিয়াল ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে নিয়ে যায়। যে কারনে বুঝতে পারি সাত নাম্বার হলো মেমোরিয়াল ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে গানিতিক চিহ্ন। তিনি আরও বলেন, টেস্ট করানোর পর রিপোর্ট নিয়ে গেলে টেস্টের ক্যাশ মেমোটি রেখে দিয়েছেন ডা. মনিরুজ্জামান।
শাহাদাত মৃধা বলেন, আমার রোগীর টেস্টের রিপোর্ট দেখার পূর্বে অন্য এক নারী তার রোগীর টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসেন। তখন পছন্দমতো ডায়াগনষ্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট না করায় ডা, মনিরুজ্জামান রোগীর স্বজন ওই নারীর ওপর চড়াও হন। এসময় ওই নারী তাকে (ডা. মনিরুজ্জামান) জানান, আপনার কথামতো ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে গিয়েছিলাম কিন্তু রিসিপশনের মেয়েটা কি টেস্টের কথা লিখেছেন তা স্পষ্ট বুঝেনি। যেকারণে বাধ্য হয়ে অন্য জায়গা থেকে টেস্ট করিয়েছি।
রোগীর স্বজন ওই নারীর মুখ থেকে এ কথা শোনার পর আমাদের সকলের সামনেই ওই ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মালিককে ফোন দিয়ে রিসিপশনে থাকা মেয়েটির প্রতি খারাপ মন্তব্য করেন। এসময় সে (ডাক্তার মনির) গরম মেজাজে আমার রোগীর রিপোর্ট দেখে ভুলভাল ব্যবস্থাপত্র লিখে দেয়। সে এন্টিবায়োটিক ওষুধ লিখলেও একই ব্যবস্থাপত্রে তা দুইবার লিখে দিয়েছেন। পরবর্তীতে ওষুধ ক্রয় করতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পরে।
অনিয়মের বিস্তার অভিযোগ : বিগত ২০২২ সালে ১৯ মে গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন গৌরনদীর নলচিড়া ইউনিয়নের পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের বাসিন্দা ডা. মনিরুজ্জামান। যোগদানের পরপরই তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ সরকারের লোক হিসেবে জাহির করতে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড গৌরনদী পৌরসভার তৎকালীন মেয়র হারিছুর রহমানের সাথে সখ্যতা গড়ে হাসপাতালে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন।
সে সময় তার (মনির) বিরুদ্ধে কর্মচারী ও হাসপাতালের পথ্য সরবরাহকারীর বিল থেকে পার্সেন্টিজ আদায়, তিন টাকার টিকিট পাঁচ টাকা আদায় করে টিকিট প্রতি অতিরিক্ত দুই টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ অনিয়মের বিস্তার অভিযোগ উঠেছিলো।
গৌরনদীতে যোগদানের পূর্বে দ্বীপ উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জ হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থাকাকালীন ডা. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বরিশালের সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন ভুক্তভোগীরা। তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপট ও তৎকালীন এক সিভিল সার্জনের সাথে সখ্যতা থাকায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ভোল্ট পাল্টানো : স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন-গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই মুহুর্তের মধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেন ডা. মনিরুজ্জামান। নিজেকে এখন বিএনপির সমর্থক দাবী করে পূর্বের সেই অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতা অব্যাহত রেখেছেন।
দীর্ঘদিন যাবত নিজ উপজেলায় দাপটের সাথে চাকরিরত এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তবে উল্লেখিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিরুজ্জামান। গাণিতিক চিহ্ন ব্যবহার করে টেস্ট বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব বিষয়ের কোন ভিত্তি নেই। একই ওষুধ দুইবার লিখে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কেহ ভুলের উর্ধ্বে নই, এরকম হতে পারে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
মেহেন্দীগঞ্জ থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগকারাই ভাল বলতে পারবে। সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মেয়রের সাথে সখ্যতা গড়ে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনিক চেয়ারে থাকায় আমাদের সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করতে হয়।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল জানান, স্বাস্থ্য খাতের যেকোন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা স্বোচ্ছার। গৌরনদীর বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যে সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমানিত হলে অবশ্যই অভিযুক্তর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।