আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ পানিকে সেভাবে গুরুত্বসহকারে নেই না। অথচ সুপেয় পানির অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই কমছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। মানবজীবনে পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলেও আমাদের দেশে সুপেয় পানি প্রাপ্তি একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির মজুত দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা আমাদের দেশসহ বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। সত্তরের দশকের আগে দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল ভূপৃষ্ঠ বা পুকুর, নদী-খাল, বৃষ্টি আর জমিয়ে রাখা পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষিকাজের জন্য দেশে প্রথম ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। সেই যে শুরু এরপর আর থামানো যায়নি। গত চার দশকে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে মারাত্মকভাবে। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, শিল্পপণ্য উৎপাদন, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। যদিও নিরাপদ নয় ভূগর্ভস্থ পানিও। ভারী ধাতুর অস্তিত্ব মিলেছে দেশের অন্তত আট জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে। পানিতে মিশে থাকা এসব ধাতু মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ব্যাপক পানিদূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। তাই এখনই আমাদের উচিত ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পানিদূষণ বন্ধ করা। ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সঙ্গে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ, যা পান করায় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে এখন বছরের একটা সময়ে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের দূষক পদার্থ চুঁইয়ে মাটির নিচে চলে গিয়ে পানিতে মিশছে। তা নলকূপের মাধ্যমে উঠে আসে। সে পানি মানব শরীরে প্রবেশ করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে নতুন রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিতে এসব মিশে দূষিত করছে নদী, নালা, খাল, বিল, সমুদ্রের পানি; এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিও। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার দূষণের অন্যতম কারণ। মাটির বিশেষ যে স্তরে আর্সনোপাইরাইট পদার্থ আছে; ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনে তা পানিতে মিশে যাচ্ছে। প্রতিদিন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহারে যে কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, ফলে ভূগর্ভে সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে ভারী ধাতু মিশে দূষণ ঘটাচ্ছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মনে রাখতে হবে আমাদের জীবনধারণের জন্য এটি একটি অত্যাবশকীয় উপাদান। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই তাই পানির সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি। সারা বছর এ বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি অন্ততপক্ষে বিশ্ব পানি দিবসে পানি দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। পানির এ দূষণ রোধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা একটি অনিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হবে।