বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক গভীর ও জটিল সংকটের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ঋণ খেলাপির সময়সীমা ১৮০ দিন থেকে কমিয়ে ৯০ দিন নির্ধারণের পর থেকেই এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও এক গুরুতর হুমকি। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে গিয়ে যেভাবে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ সীমিত করা হয়েছে, তাতে সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গঠিত পুনঃতফসিল বাছাই কমিটি এখনও পর্যন্ত জমাকৃত ১,২৫৩টি আবেদন থেকে মাত্র ৫৬টি প্রাথমিকভাবে বাছাই করলেও কোনো আবেদন চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেনি। ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে স্বাভাবিক আর্থিক কার্যক্রমে ফিরতে পারছেন না। এই জটিলতা ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বাড়াচ্ছে, একই সঙ্গে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে। ২০২৫ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকায়, যার মধ্যে ৮১.৩৮ শতাংশই মন্দ ঋণ-অর্থাৎ আদায়যোগ্য নয় বললেই চলে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলেও বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রভিশন ঘাটতি এক বছরের ব্যবধানে প্রায় সাত গুণ বেড়ে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর ফলশ্রুতিতে প্রভিশনের হার নেমে এসেছে ৩৮ শতাংশে, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন ঘাটতি এবং ঋণ পুনর্গঠনে ধীরগতির সম্মিলিত প্রভাব দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও বিনিয়োগ পরিবেশকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যবসায়িক ঋণে সুদের হার বৃদ্ধি এবং সাধারণ ভোক্তাদের ওপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। এই সংকটের পেছনে কেবল আইএমএফের শর্ত নয়, বরং নীতিনির্ধারণী অদূরদর্শিতা, সময়োচিত সংস্কারের ঘাটতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারিতাও দায়ী। খেলাপি ঋণ নিরসনে নীতিগত শিথিলতা নয়, বরং কার্যকর, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী সংস্কার জরুরি। ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে হলে বাছাই কমিটির কাজের গতি বাড়াতে হবে, আর্থিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আবেদন যাচাই দ্রুত করতে হবে এবং যেসব ঋণদাতা ব্যাংক ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি, এই সংকট শুধু ব্যাংক খাতের নয়-এটি গোটা অর্থনীতির। এর দ্রুত ও কার্যকর সমাধান না হলে এর অভিঘাত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকেও বিপর্যস্ত করে তুলবে। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে-এখনই।