রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল একক উন্নয়ন প্রকল্প। প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার এই উদ্যোগ কেবল জ্বালানি খাতে এক নতুন দিগন্তের প্রতিশ্রুতি নয়, এটি ছিল বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার এক প্রতীকও। কিন্তু বারবার সময় পরিবর্তন, অনিশ্চয়তা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে আজ এই প্রকল্পটি উদ্দীপনার পরিবর্তে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও এখন তা পিছিয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের ক্ষেত্রেও একইরকম বিলম্ব। যদিও সঞ্চালন লাইন ইতোমধ্যে প্রস্তুত, ফুয়েল লোডিং শুরু হয়নি। আবার ফুয়েল লোড হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় না-এর জন্য প্রয়োজন আরও একাধিক ধাপ ও ১০০ দিনের মতো সময়। এই বিলম্বের ব্যাখ্যা প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা দিয়েছেন, কিন্তু জনমানসে প্রশ্ন রয়ে গেছে-যেখানে বেলারুশ রাশিয়ার সহায়তায় সাত বছরে একটি নিউক্লিয়ার প্লান্ট চালু করতে পেরেছে, সেখানে আমাদের ক্ষেত্রে আট বছর পরেও শুধুমাত্র তারিখ পিছানোর সংস্কৃতি চলছেই কেন? আরও উদ্বেগজনক হলো, ছয় মাস ধরে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের আগমন বন্ধ রয়েছে, যারা এই প্রকল্পে যন্ত্রপাতি বুঝে নেওয়া ও নির্মাণ তদারকিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদের অনুপস্থিতি প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ফাঁকফোকরের ইঙ্গিত দেয়। সেইসঙ্গে চাকরিতে বৈষম্য, কর্মী অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জল্পনা প্রকল্পকে আরও অস্থির করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে-এতো আগে রূপপুরে আনা নিউক্লিয়ার ফুয়েলের গুণগত মান কি প্রকৃত অর্থে রক্ষা করা সম্ভব? নিউক্লিয়ার রিএক্টরে ব্যবহৃত ফুয়েল যদি দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকে, তবে তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে যৌক্তিক উদ্বেগ তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা বা বিনিয়োগকারী রাশিয়ার কাছে বাংলাদেশের পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে, তা অবহেলার বিষয় নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই প্রকল্পে সময়মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু না হওয়ায় বহুমাত্রিক ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে প্রকল্প ব্যয় অপরিবর্তিত থাকলেও বাড়ছে সময় ও ব্যবস্থাপনার খরচ। এসবই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ‘পার ইউনিট কস্ট’ বাড়িয়ে তুলবে। ফলে দেশের নাগরিকরা প্রত্যাশিত সাশ্রয় নয়, বরং উচ্চমূল্যের জ্বালানির চাপেই পড়বেন। এখন সময় এসেছে প্রকল্পের গঠনগত ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো পর্যালোচনা করে, একটি নির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রকাশ করার। রূপপুর কবে বিদ্যুৎ দেবে, এ নিয়ে শুধু প্রকল্প কর্মকর্তাদের বক্তব্যে নয়, প্রয়োজন জনস্বার্থে দায়বদ্ধ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের। জাতীয় স্বার্থে এমন একটি প্রকল্পে আর বিলম্ব বা অনিশ্চয়তার কোনো জায়গা নেই। রূপপুর শুধু একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তি, পররাষ্ট্র কূটনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার প্রতীক। এই প্রতীক যেন আস্থার সংকটে বিলীন না হয়ে যায়-তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।