রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপন ব্যালটের ব্যবহার এবং প্রার্থীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে একমত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২৩তম দিনে এই ঐকমত্যে পৌঁছায় তারা। দুপুরের বিরতির পর কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উপস্থাপন করলে আলোচনা শেষে সকল দল তাতে সম্মতি দেয়।
কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, দেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি জাতীয় সংসদের নিম্ন ও উচ্চকক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। সংবিধানের ৪৮(৪) অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতাগুলো বহাল রাখা হবে। সেই সঙ্গে নতুনভাবে প্রস্তাবিত ৪৮(৪)(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রার্থীকে রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা রাজনৈতিক কোনো দলের পদে থাকা যাবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংলাপ শেষে বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান এবং সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এমপিরা দলীয় হুইপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও জানান, উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে বিএনপি বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আসনভিত্তিক কাঠামো চায়, তবে সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার তারা উচ্চকক্ষকে দিতে নারাজ। বিএনপির প্রস্তাবে উচ্চকক্ষ আইন পর্যালোচনা ও সুপারিশ করতে পারবে, কিন্তু সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকবে শুধুমাত্র নিম্নকক্ষের হাতে। এই প্রস্তাবে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, সরাসরি নির্বাচিত না হওয়ায় উচ্চকক্ষের সদস্যদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের চিন্তা গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী।
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের ৪৮(৩) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু বিএনপি রাষ্ট্রপতির কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব চায়, যা সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
এদিন আলোচনায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মত বিনিময় হয়। এর মধ্যে রয়েছে—তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটি মধ্যবর্তী বিধানের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাব্যতা, মৌলিক অধিকার পুনর্মূল্যায়ন করে ইন্টারনেটের অধিকারসহ আধুনিক সময়ের উপযোগী কিছু অধিকার সংযোজন, এবং ন্যায়পাল, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়োগের বিধান নিয়ে পুনর্বিবেচনা।
সংলাপে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ এবং সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া।
সংলাপে ‘জুলাই সনদ-২০২৫’ নিয়েও আলোচনা হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সনদটিকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং এটি একটি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতিফলন এবং জনগণের অভিপ্রায়—যা আইনের ঊর্ধ্বে। বিএনপির মতে, এটি “জনগণের লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন” এবং সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করা উচিত।
রাষ্ট্রের মূলনীতি বিষয়ে আলোচনায় বিএনপি ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’—এই বাক্যটি সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে সম্মতি দিলেও অন্য দলগুলোর কিছু আপত্তি থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়।
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জুলাই সনদের পটভূমির একটি খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে, যেখানে সবাই স্বাক্ষর করবে এবং বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে।