জুলাইযোদ্ধা হাসান সরদারের প্রতিটি মুহুর্ত কাটে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায়। সেদিন মৃত ভেবে হাসানকে ফেলে রাখা হয়েছিলো হাসপাতালের ফ্লোরে। পিতৃহারা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হাসান বর্তমানে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। শরীরে অসংখ্য বুলেটের যন্ত্রণায় রাতে সে ঘুমাতে পারছেন না। শরীরে চারশ’ স্প্লিন্টারের ক্ষত বয়ে বেড়ানো হাসানকে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তার আর চিকিৎসা সম্ভব নয়।
রাজধানী ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা ও সাভারের সিআরপিতে থেরাপি নেওয়ার পর বর্তমানে তিনি গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। আহত জুলাইযোদ্ধা মো. হাসান সরদার (২১) বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের পতিহার গ্রামের মৃত মানিক সরদারের ছেলে। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে হাসান সবার বড়। ঢাকায় ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করেই চলছিলো তাদের সংসার।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনাবিরোধী অভ্যুত্থান চলাকালে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রথমে ঢাকার রামপুরা ব্রিজ এলাকায় পায়ে গুলি লেগে আহত হন হাসান সরদার। এরপর কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লগ্নে আবার তিনি (হাসান) আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সেদিন বাড্ডায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। এতে হাসানের সারা শরীরে প্রায় চারশ’র মতো স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে প্রাণ ফিরে পাওয়া জুলাই আন্দোলনের গুলিতে গুরুত্বর আহত মো. হাসান সরদার রোববার দুপুরে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের কাছে সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বর্ননা করতে গিয়ে বলেন, ‘আজও মনে পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কথা। ঢাকার রামপুরা ব্রিজের সামনে ছাত্র আন্দোলনে ১৮ জুলাই পুলিশের গুলি পায়ে লেগে আহত হই। পরে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেও ভয় পেয়েছি। কারণ পুলিশ যদি আবার ধরে নিয়ে যায়, সেই ভেবে চরম আতঙ্কে ছিলাম। পরে একটি বাসায় বসে আমিসহ আরো কয়েকজনে এক চিকিৎসকের মাধ্যমে অতিগোপনে চিকিৎসা গ্রহণ করে একটু সুস্থ হয়ে ৫ আগস্ট আবার আন্দোলনে যাই।
ওইদিন আন্দোলনে গিয়ে বাড্ডার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে পুলিশ আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। আমার ডান হাতে, পাঁজরে এবং মুখে পুলিশের ছোড়া কয়েকশ’ গুলি লাগে। এতে আমি রক্তাক্ত জখম হই। স্থানীয়রা প্রথমে আমাকে আফতাবনগর নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার তখন জ্ঞান ছিল না। পরবর্তীতে জ্ঞান ফেরার পর আমাকে উদ্ধারকারীদের কাছে শুনেছি-সবাই মনে করেছিল আমি সেদিন মারা গিয়েছি। এই ভেবে আমাকে নাগরিক হাসপাতালের ফ্লোরে ফেলে রাখা হয়েছিলো। এরপর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন দেখতে পেল আমি জিবীত রয়েছি তখন আমাকে মুগদা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরেরদিন ৬ আগস্ট আমার জ্ঞান ফিরে আসলে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওইদিন রাতে অপারেশন করার কথা বলে আমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে আমাকে অপারেশন না করে অপারেশন রুম থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এরপর ৭ আগস্ট সকালে আমাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কুর্মিটোলা হাসপাতালে আমাকে ভর্তি না করে আবার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার পর ৭ আগস্ট রাতে পুনরায় আমি পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হই। কয়েকদিন পর আমাকে সাভার সিআরপিতে পাঠানো হয় থেরাপি দেয়ার জন্য। সেখানে থেরাপি শেষে আবার পঙ্গু হাসপাতালে চলে আসি। পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হই।
হাসান সরদার বলেন, সবশেষে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আমার শরীরে যে গুলি রয়েছে, তা বাংলাদেশে অপারেশন করে বের করা সম্ভব হবে না। আমার হাতে ও শরীরে প্রায় চারশ’ গুলির স্প্লিন্টার রয়েছে। এখন আমাকে বিদেশে চিকিৎসা করানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ইতিপূর্বে আমি ধারদেনা করে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরেছি। বাড়িতে আসার পর কেউ আমার কোনোধরনের খবর নেয়নি। টাকার অভাবে আমার ভাই-বোনের কলেজের ফি পর্যন্ত দিতে পারিনি। আমার ঘরে খাবার পর্যন্ত নেই।
হাসান সরদার বলেন, পুলিশের গুলিতে গুরুত্বর আহত হয়ে আজ আমি কর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে এখন আমার ছোট ভাই-বোনের পড়াশুনার ব্যয়ভারসহ পরিবারের ভরনপোষন জোগাড় করা নিয়ে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, স্প্লিন্টারের কারণে এখন রাতের বেলা ঘুমাতে পারছিনা। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে এখন প্রতিটি রাত কাটাতে হচ্ছে।
আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিখন বণিক বলেন, মো. হাসান সরদার জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে গুরুত্বর আহত হয়েছিলেন। তিনি আমাদের সরকারি তালিকাভুক্ত একজন আহত ব্যক্তি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে খুব শীঘ্রই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।