জুলাইয়ের রক্তস্রোতের পর বিজয়ের ৫ আগস্ট আজ: ইতিহাসের বাঁকে এক নতুন সূচনা

আলিফ হাসান; বিশেষ প্রতিবেদক | প্রকাশ: ৫ আগস্ট, ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
জুলাইয়ের রক্তস্রোতের পর বিজয়ের ৫ আগস্ট আজ: ইতিহাসের বাঁকে এক নতুন সূচনা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হয়ে থাকল একটি যুগান্তকারী দিন। দীর্ঘ একমাসের রক্তাক্ত আন্দোলনের পর এ দিনেই ভেঙে পড়ে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের প্রাচীর। ঢাকার রাজপথে লাখো মানুষের ঢল, শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং স্বৈরশাসনের পতন—সব মিলিয়ে এ দিনটি এখন ইতিহাসে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত।

জুন-জুলাইজুড়ে সারাদেশজুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জন্ম নেয় ‘একদফা শেখ হাসিনার পদত্যাগ’-এর দাবিতে উত্তাল গণআন্দোলন। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ একাধিক শিক্ষার্থীর হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর একের পর এক আক্রমণ, হতাহতদের তালিকা আর সরকারের বেপরোয়া দমননীতির বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র, যুবক, নারি, বৃদ্ধ—সবাই রাস্তায় নেমে আসে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে শেষ চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিন নির্ধারিত হয় ৫ আগস্ট, সোমবার।

ওই দিন সকাল থেকেই ঢাকার দিকে মানুষ ছুটে আসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। দুপুর গড়াতেই রটে যায় শেখ হাসিনা দেশের বাইরে চলে গেছেন। মুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। লাখো মানুষ ঢাকার কেন্দ্রস্থল—সংসদ ভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভিড় করে। এক অভূতপূর্ব দৃশ্যে গণভবনের মসনদে নিজের চোখে শেখ হাসিনার অনুপস্থিত ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করতে দেখা যায় সাধারণ মানুষকে। এভাবেই অবসান ঘটে সাড়ে ১৫ বছরের একচ্ছত্র শাসনের।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ১১৮ শিশুসহ মোট এক হাজার ৪০০ জন হত্যার তথ্য উঠে আসে। আহত হন অন্তত ১২ হাজার মানুষ। এসব হত্যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমনটাই উঠে আসে আন্তর্জাতিক তদন্তে।

অভ্যুত্থানের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ৪ আগস্ট, রোববার রাতে সরকার সর্বশেষ চেষ্টায় মাঠে নামে আন্দোলন দমন করতে। একাধিক বৈঠক হয় গণভবনে, যেখানে অংশ নেন শেখ হাসিনা, তাঁর ঘনিষ্ঠরা, তিন বাহিনীর প্রধান এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, শেখ হাসিনা শেষ সময়েও সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর চাপ দেন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের জন্য। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোরও পরামর্শ দেন তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক।

তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়—সময় ফুরিয়ে গেছে। ৫ আগস্ট ভোরে সেনাপ্রধান ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত বিকেলের এক বৈঠকের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। ওই সময়েই খবর আসে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন।

পরবর্তীতে ২৫ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, ৪ আগস্টের রাতে শেখ হাসিনার সঙ্গে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক দফায় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার নামে আরও রক্তপাতের পরিকল্পনা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে প্রত্যাখ্যাত হয় সেই প্রস্তাব। অতঃপর ঘটনার মোড় ঘুরে যায়।

এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্টকে সরকারিভাবে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছর দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দিবসটির ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

এই দিনটি এখন শুধু একটি সরকার পতনের ঘটনা নয়, বরং গণমানুষের বিজয়, আত্মত্যাগ, ঐক্য আর গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনার এক ঐতিহাসিক প্রতীক হয়ে উঠেছে।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগের মুহূর্ত ও দেশত্যাগ
৫ আগস্ট ভোর থেকে ঢাকার রাজপথে লক্ষাধিক মানুষ পদযাত্রা শুরু করে গণভবন অভিমুখে। সেনা কর্মকর্তারা তখন থেকেই সক্রিয় ছিলেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতিতে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে বলেন, সেদিন সকালেও গণভবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। শেখ হাসিনা তখনকার আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেখিয়ে বলেন, “ওরা ভালো কাজ করছে, সেনাবাহিনী পারবে না কেন?” তখন আইজিপি জানান, বাহিনী ক্লান্ত, অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং আর বেশি সময় পুলিশ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয়।

সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে গণভবনের একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে গিয়ে আবারও পদত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনা রাজি হচ্ছিলেন না। এমন সময় শেখ রেহানা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। পরে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তারা যোগাযোগ করে তাঁকে বলেন, মায়ের জীবন বাঁচাতে হলে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। জয় পরে মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রাজি করান।

সকাল থেকেই সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশে ভাষণের প্রস্তুতি চলছিল। আইএসপিআর থেকে বিটিভিকে জানানো হয়, সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় ভাষণ দেবেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি ভাষণ দেন বিকেল ৪টায়।

সেদিন শেখ হাসিনা কীভাবে দেশত্যাগ করেন, তা নিয়ে নানা বিবরণ রয়েছে। গত বছরের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সরাসরি বঙ্গভবনে না গিয়ে প্রথমে গাড়িতে করে বাণিজ্য মেলার মাঠে যান, সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে কুর্মিটোলা এয়ারবেসে যান। পরে সেখান থেকে বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে (সি-১৩০) তাঁরা ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। বিমানটি ৫ আগস্ট বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে ভারতের গাজিয়াবাদে অবতরণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্দন ঘাঁটিতে তখন তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।

এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা এখনও ভারতে অবস্থান করছেন। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর একাধিক অডিও বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, তাঁর সঙ্গে আরও অনেক সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী দেশ ছেড়ে ভারতে অবস্থান করছেন।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে