বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, সোমবার একটি স্মরণীয় দিন। এক বছরের ব্যবধানে দিনটি হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক জাগরণের প্রতীক। সেদিন ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে, দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাত্র ৪৫ মিনিটের নাটকীয় এক সময়ের মধ্যে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরিস্থিতির চাপে দ্রুত সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আজও দেশবাসীর কাছে রহস্যে ঘেরা হলেও, সময়ের সাথে ফাঁস হতে থাকা তথ্যচিত্র ও অংশগ্রহণকারীদের বয়ান সেই ঘটনাকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
উত্তাল ভোরের সূচনা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, সোমবার সকাল থেকেই সারাদেশে জারি ছিল কারফিউ। আগের রাতেই (রোববার) নিরাপত্তাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ফজরের পর থেকেই হাজার হাজার মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে, গলিতে, রাজপথে মানুষের স্রোত যেন পাথরের বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসা নদীর মতো ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকার দিকে এগিয়ে আসা এই গণজোয়ারের সামনে প্রশাসন একপ্রকার ভেঙে পড়ে। সকাল ১০টার দিকে শেখ হাসিনা জরুরি ভিত্তিতে তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থানে থাকলেও সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন—আর কিছু করার নেই, আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
৪৫ মিনিটের সংকটময় সময়
বৈঠকে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে ডাকা হয় তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে। তাকে বলা হয়, সময় থাকতে বড় বোনকে দেশ ছাড়তে রাজি করান। এরপর সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মা শেখ হাসিনাকে বোঝানো হয়, যেন তিনি পদত্যাগ করে অবিলম্বে দেশ ত্যাগ করেন।
প্রথমে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে সময় চান এবং একটি ভিডিওবার্তা জাতির উদ্দেশে প্রচার করার শর্ত দেন। কিন্তু তখন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে জানিয়ে দেন, শাহবাগ থেকে ছাত্র-জনতার ঢেউ গণভবনের দিকে রওনা হয়েছে এবং সেখানে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট লাগবে। এর মধ্যে দেশ না ছাড়লে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। অর্থাৎ তার হাতে সময় মাত্র ৪৫ মিনিট।
হেলিকপ্টারে গোপন প্রস্থান
তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সড়কপথে নয়, আকাশপথে দেশ ত্যাগ করবেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রথমে গণভবন থেকে গাড়িতে করে নিকটস্থ বাণিজ্য মেলার মাঠে আনা হয় তাদের। সেখান থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে নেওয়া হয় কুর্মিটোলার বঙ্গবন্ধু এয়ারবেইসে। সঙ্গে নেওয়া হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও লাগেজ।
সেখান থেকে বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমান (সি-১৩০) যোগে তারা ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। ভারতের স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে বিমানটি নয়াদিল্লির নিকটবর্তী গাজিয়াবাদে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। সেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নিজে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান।
গণভবনে প্রবেশ ছাত্র-জনতার
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে, হাজারো মানুষ গণভবনের গেটে পৌঁছে যায়। মুহূর্তেই গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। গণভবনের ভেতরের অনেক জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, কিছু নিখোঁজও হয়। তখন শেখ হাসিনা মাঝ আকাশে, নতুন এক বাস্তবতায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব থেকে চিরবিদায়ী।
সেদিনের গণজাগরণ শুধু একজন শাসকের প্রস্থান নিশ্চিত করেনি, বরং নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচন করেছে—যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস জনগণ, এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে জনতার ইচ্ছাই মুখ্য।