গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর কাজ শতভাগ শেষ হলেও টানা চতুর্থ বারের মতো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন পরিবর্তন করা হয়েছে । সব শেষে গতকাল ২ আগষ্ট এটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও অনিবার্য কারণ দেখিয়ে আগামী ২৫ আগষ্ট সেতুর উদ্বোধনের দিন নির্ধারণ করা হয়। তবে তার আগেই সেতুর দুই প্রান্তে তৈরি হয়েছে উৎসবের আমেজ। প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসছেন সেতু দেখতে ফলে স্বপ্নের তিস্তা সেতু এখন পরিনত হয়েছে বিনোদন কেন্দ্রে ।
সেতুটি নির্মিত হয়েছে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুরঘাট এলাকায়। জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। এর অপর প্রান্তে কুড়িগ্রামের চিলমারী ঘাট।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, সেতুটি নির্মিত হয়েছে সৌদি সরকারের অর্থায়নে, চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে। ৮৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১,৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৬ মিটার প্রস্থের পিসি গার্ডার সেতুটি বাস্তবায়নে সরাসরি তদারক করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। দেশের ইতিহাসে এটিই এলজিইডির সর্ববৃহৎ প্রকল্প।
সেতুটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে প্রায় ৮০ কিলোমিটার এক্সেস সড়ক, যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৫৮টি বক্স কালভার্ট ও ৯টি আরসিসি সেতু। বেলকা বাজার, পাঁচপীর, ধর্মপুর, হাট লক্ষ্মীপুর, সাদুল্যাপুর ও ধাপেরহাটসহ অন্তত ১০টি বাজার ও মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে পুরো সুন্দরগঞ্জ ও চিলমারী অঞ্চল।
দেশে এর আগে আর কখনো এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়নি এলজিইডি। সে হিসেবে এটি চালু হলে যেমন দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হবে দুই জেলার লাখো মানুষের। সেইসঙ্গে ব্যতক্রমী এক মাইলফলকে পা রাখবে এলজিইডি।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, নানা বয়সী মানুষ সেতু দেখতে এসেছেন। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেতুর ওপর হাঁটছিলেন, ছবি তুলছিলেন। শিশুদের জন্য নাগরদোলা বসানো হয়েছে, আশপাশে গড়ে উঠেছে খেলনা ও খাবারের অস্থায়ী দোকান। কেউ নদীর জলে পা ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন, কেউ দল বেঁধে গোসল করছিলেন, আবার কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘লাইভ’ করছেন সেতুর সৌন্দর্য তুলে ধরতে।
সেতু এলাকার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, আগে এখানে ছিল একটি নৌঘাট, আর দু-একটি দোকান। এখন সেখানে বেশ কিছু দোকান হয়েছে, মানুষের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠেছে এলাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যও বেড়েছে।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা গ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে আসা ব্যবসায়ী মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিস্তা সেতুর দৃষ্টিনন্দন ছবি দেখে বেশ ভালো লেগেছে। তাই সচক্ষে সেতুটি দেখতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছি। নদীতে নৌকায় করে ঘুরেছি। বাচ্চারা নাগরদোলায় উঠেছে, খেলনা কিনেছে। বাচ্চারাও অনেক খুশি হয়েছে।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধর্মপুর গ্রাম থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূর থেকে বাবার সঙ্গে বাইসাইকেলে চড়ে আসা সাত বছরের আশামণি বলে, ‘এত্তি আসি বাবার সাথে নাগরদোলাত চড়চি। ফুচকা খাচি। চুরি-মালা কিনছি। বাড়িত ছোট ভাইট্যার জন্নে ঝুনঝুনি, খেলনা কিনছি। খুব ভালো নাগচে।’
গাইবান্ধা জেলা শহরের বাসিন্দা মফিজুল হক বলেন, ‘কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বর্ষাকালে নদীতে স্রোত বেশি থাকলে নৌকা চালাতে ভয় লাগে, তাই ঘুরে রংপুর হয়ে যেতে হয়। এতে সময় ও খরচ দুই-ই বাড়ে। সেতু চালু হলে সেই কষ্ট থাকবে না, ঝুঁকিও কমবে।
১৯৯০ সাল থেকে এখানে একটি সেতু নির্মাণের জন্য সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছিলেন বলে জানান সুন্দরগঞ্জের তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শরিয়ত উল্যা। তিনি বলেন, ‘অবশেষে এলাকাবাসীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি মাসেই সেতুটি উদ্বোধনের কথা শুনেছি। এখন এই দুই জেলার মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের শেষ নাই।’
গত ৪ জুলাই তিস্তা সেতু পরিদর্শনে যান স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশীদ মিয়া ও যুগ্ম সচিব মো. সামছুল ইসলাম।
এদিকে সেতু ও সংযোগ সড়ক চালু হলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার কমে আসবে। কেবল কুড়িগ্রাম নয়, উত্তরাঞ্চলের আরও কয়েকটি জেলার ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। গাইবান্ধার মতো তুলনামূলক পশ্চাৎপদ একটি জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নও ঘটবে।
গাইবান্ধা জেলা দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মাকসুদার রহমান বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক থেকে গাইবান্ধা শহর ২১ কিলোমিটার দূরে। এ কারণে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার পায় না। তিস্তা সেতু ও সংযোগ সড়ক চালু হলে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ গাইবান্ধা শহরের ভেতর দিয়ে ঢাকায় যাতায়াতের সুযোগ পাবেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব খাতে উন্নয়ন হবে।
গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, ‘দেশে এলজিইডির সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই তিস্তা সেতু। সেতুটি উন্মুক্ত হলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব কমবে ১৩৫ কিলোমিটার। এতে সময় সাশ্রয় হবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে । আগামী ২৫ শে আগষ্ট এই সেতু উদ্বোধন হবে ফলে এই দুই জনপদে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হবে, নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থান বাড়বে।’