রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস উড়োজাহাজে উপর্যুপরি ত্রুটি নিয়ে বিপাকে রয়েছে। ত্রুটির কারণে বিমানের উড়োজাহাজ বিলম্বে ছাড়ার পাশাপাশি ফ্লাইট বাতিলের ঘটনা বাড়ছে। রানওয়েতে আটকে পড়া, চাকা খুলে পড়াসহ নানা সমস্যা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজগুলোর প্রতিদিনকার চিত্র হয়ে উঠেছে। গত জুলাই-আগস্ট মিলিয়ে এক মাসে অন্তত ১৮টি উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছে। ওই কারণে আকাশপথে বিমানের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। তাতে ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয়ের পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ে। উড়োজাহাজে ঘন ঘন ত্রুটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিপর্যস্ত। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আকাশপথে রাষ্ট্রীয় সংস্থার বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলো একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ছে। ওসব যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ওসব উড়োজাহাজের কোনোটি উড্ডয়নের পর গন্তব্যের মাঝপথ থেকে দেশে ফিরে এসেছে। আবার কোনোটিতে উড্ডয়নের আগেই ত্রুটি ধরা পড়েছে। এমনকি আকাশ থেকে উড়োজাহাজের চাকা খুলে মাটিতে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। আর ওসব প্রায় সব ঘটনাই আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিমানে নিয়মিত ভ্রমণকারী দেশি-বিদেশি যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে বেছে নিচ্ছে অন্য এয়ারলাইনস। ফলে বিমান যাত্রী হারানোর পাশাপাশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারী হচ্ছে সংস্থাটির লোকসানের পাল্লা।
সূত্র জানায়, বিমানের উড়োজাহাজে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় রক্ষণাবেক্ষণে বিমানের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, নাকি ইচ্ছাকৃত নাশকতা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিমান সংশ্লিষ্ট কারো কারো মতে উড়োজাহাজের এমন অবস্থা অস্বাভাবিক। হয়তো আগামী দিনে ২৫ বোয়িং উড়োজাহাজ ক্রয়কে ত্বরান্বিত করতেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বর্তমানে উড়োজাহাজে গোলযোগ নিয়ে বিমানকে সময়সূচি ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদিও বিমানের দাবি, উড়োজাহাজে কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে হ্যাঙ্গারে নেয়া হয়। সেখানে মেরামত শেষে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। কিন্তু উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর আবার অন্য ত্রুটি ধরা পড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে বেশি ঘটছে এমন ঘটনা। তাছাড়াও বর্তমানে একটি কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিমান। জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রার সংকট এবং প্রতিযোগী এয়ারলাইনসের ভাড়া-নীতির কারণে প্রভাবিত হয়েছে বিমানের টিকিট বিক্রি। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ভিসা জটিলতার কারণে যাত্রী পরিবহন হ্রাস পেয়েছে। ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরগামী ফ্লাইটেও প্রতিযোগী এয়ারলাইনসের সেবা ও ভাড়া সুবিধার কারণে যাত্রী হারাচ্ছে বিমান। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিমানের লোকসান কয়েক হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বেড়ে চলেছে ঋণের বোঝাও। তাছাড়া বিমানের বহরে থাকা বোয়িং উড়োজাহাজগুলো যখন একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ছে, তখন সরকার চিন্তা করছে নতুন করে আরো ২৫টি বোয়িং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনার। বর্তমানে বিমানের বহরের ২১টি এয়ারক্রাফটের মধ্যে ১৬টি বোয়িং। তার মধ্যে ৬টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর আর ৬টি ন্যারোবডির বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ রয়েছে। তার বাইরে বিমানের বহরে স্বল্প দূরত্বের রুটে চলাচল উপযোগী ৫টি ড্যাশ-৮০০ উড়োজাহাজ রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বিমানের উড়োজাহাজে শুধু যান্ত্রিক ত্রুটিই নয়, বিমানের উড়োজাহাজে তেলাপোকা, পোকামাকড় ও তীব্র দুর্গন্ধের কারণে ব্যাগেজ ডেলিভারিও স্থগিত করার মতো ঘটনা ঘটেছে। গত ২৯ জুলাই ইতালির রোমের স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টায় বিমানের বিজি-৩৫৫ ফ্লাইটের যাত্রী ব্যাগেজ দেয়ার সময় ফিউমিচিনো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষঅসংখ্য তেলাপোকা, পোকামাকড় ও তীব্র দুর্গন্ধ পায়। তাৎক্ষণিকভাবে রোম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যাগেজ ডেলিভারি স্থগিত করে। তারপর বিমানবন্দর স্বাস্থ্য বিভাগের একটি দল জীবাণুনাশক কার্যক্রম শুরু করে। ওই দিনই রোমের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে বিজি-৩৫৫ ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বিমানের উড়োজাহাজটির ব্যাগেজ কনটেইনার জীবাণুমুক্ত করতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। পরে সব কাজ শেষ করে রাত সোয়া ১১টায় উড্ডয়নের অনুমতি দেয় রোমের ফিউমিচিনো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই সময় যাত্রীরা উড়োজাহাজের ভেতরে আটকে ছিলেন। ওই ঘটনা জানিয়ে গত ৩১ জুলাই ঢাকায় বিমানের সদর দফতরে একটি চিঠি দেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রোম স্টেশন ম্যানেজার। চিঠিতে যাত্রী ও ব্যাগেজ গ্রহণের সময় বিমানের সংশ্লিষ্টদের আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে বিমান সংশ্লিষ্টদের মতে, বিমানের বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে কয়েকটি বেশ পুরোনো। আর যেকোনো যান্ত্রিক যান পুরোনো হলে তার যন্ত্রাংশে ত্রুটি দেখা দেবেই। বিমানের কোনো যন্ত্রে যদি ত্রুটি দেখা দেয়, সেটি মেরামতের সুযোগ নেই। সেজন্য পুরো যন্ত্রটিই পরিবর্তন করতে হয়। যে কারণে প্রকৌশল বিভাগকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু বিমানের প্রকৌশল বিভাগে দক্ষ জনবল সংকট রয়েছে। এখন যারা কর্মরত তারা অতিরিক্ত চাপে ক্লান্ত। তার মধ্যে এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজের ত্রুটির ঘটনাগুলো নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়নের আগে প্রযুক্তিগত পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক এ বি এম রওশন কবীর জানান, উপর্যুপরি উড়োজাহাজে ত্রুটির ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষ একাধিক তদন্ত কমিটি করেছে। পাশাপাশি প্রকৌশল বিভাগ সতর্কতার সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। গত কিছু দিনে অনেক উন্নতিও হয়েছে। যদিও আশ্চর্যের বিষয় ঘটনাগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটেছে। তবে একই সমস্যা কিন্তু বারবার হচ্ছে না। এটা সত্যিকার অর্থেই অস্বাভাবিক। বিমানের প্রকৌশল বিভাগ সেগুলোর সমাধানও করছে। আশা করা যায় দ্রুতই ওসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।