নিরাপদ সড়ক সবারই কাম্য

প্রকাশ ঘোষ বিধান | প্রকাশ: ২২ অক্টোবর, ২০২৫, ০৮:১১ এএম
নিরাপদ সড়ক সবারই কাম্য
প্রকাশ ঘোষ বিধান

প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় কেড়ে নিচ্ছে তরতাজা প্রাণ। মুহূর্তেই খালি হচ্ছে কোনো না কোনো মায়ের কোল। অনেকেই আবার বেঁচে থাকছে পঙ্গু হয়ে। ভুগতে হয় সারা জীবন। তাই তো বলা হয়ে থাকে একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। দুর্ঘটনা যেভাবেই হোক না কেন, তার ফল সব সময় ভয়ংকর হয়ে থাকে। দুর্ঘটনা কবলিত একটি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে অমানবিক কষ্ট ভোগ করে থাকে। তাদের এই ক্ষতি অপূরণীয়।

প্রতি বছর অক্টোবর মাসের ২২ তারিখে বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়। এই দিবসটি সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্যাপন করা হয়। যদিও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনটি প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে, যা নিরাপদ সড়কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হয়।

২০১৭ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবছর দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি নিসচাসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা কেবল সরকারের একার দায়িত্ব নয় বরং এটি প্রত্যেক নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দায়িত্ব।

নিরাপদ সড়ক মানেই জীবনের নিরাপত্তা। সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটায়, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক দেশের চেয়েও বেশি। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সড়ক দুর্ঘটনা মানবসম্পদের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি।

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যাবার পথে পটিয়ার সড়কে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সহধর্মিণী জাহানারা কাঞ্চন এক মারাত্মক রোড ক্র্যাশে মৃত্যুবরণ করেন। ইতঃপূর্বে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বাংলায় সড়ক দুর্ঘটনা হিসাবে ব্যবহৃত হলেও বিশ্বে এখন রোড অ্যাক্সিডেন্ট-এর পরিবর্তে রোড ক্র্যাশ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। স্ত্রীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়া ইলিয়াস কাঞ্চন নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলেন। সেই থেকে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করে আসছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।

পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয় এই স্লোগান নিয়ে গড়ে তোলেন সামাজিক সংগঠন-নিরাপদ সড়ক চাই। নিসচার পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবরকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানানো হয়। চলচ্চিত্রে ওই সময়ের জনপ্রিয়তাকে মাড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের সড়কে মানুষের মৃত্যুর নীরব মিছিল থামাতে প্রতিজ্ঞা করেন। এ লক্ষ্যে স্ত্রী হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই, ১ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করার উদ্যোগ নেন এবং ১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপদ সড়ক চাই প্রতিষ্ঠা করেন।

চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে, খুব অল্প সময়েই নিসচা সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে এবং ১৯৯৪ সাল থেকে, প্রতিবছর ২২ অক্টোবর দিনটিকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসাবে পালন শুরু হয়। তখন থেকেই এ দিবস উদ্যাপনে সরকার, বিশেষত, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও গত ৮ বছর যাবৎ এ দিনটি উদ্যাপনে সরকার প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২০১৮ সালে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।

পরবর্তীতে ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্র্যাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়; যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছিল।

তবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যদি আমরা নিয়মাবলি মেনে চলি এবং সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে অধিক সচেতন ও সতর্ক হই তাহলে তা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে আগে নিজেদের সচেতন হতে হবে। আমরা নিজেরা যতদিন সচেতন হব না, ততদিন সড়কের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব হবে না। নিজেরা রাস্তা দখল করে দোকান-পাট, বাড়ি-ঘর তৈরি করা, রাস্তাকে আবর্জনার স্তূপ, যত্রতত্র মালামাল রাখা, গাড়ি পার্কিং করা, বেপরোয়া গাড়ি চালালে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বা অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো, আইন না মেনে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করলে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

নিরাপদ সড়ক সবার কাম্য। এটি অর্জনের জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এর জন্য সড়কের আইন ও নিয়মকানুন মেনে চলা, ট্র্যাফিক নিয়ম লঙ্ঘন না করা এবং সড়ককে নিরাপদ করার জন্য উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা শুধু সরকারের একার নয় বরং চালক, যাত্রী এবং সাধারণ পথচারী সবার সম্মিলিতভাবে সড়ককে নিরাপদ করার চেষ্টা করতে হবে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গণ-আন্দোলনের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, ড্রাইভিং, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, অবৈধ যানবাহন সড়ক নিরাপত্তার যে ঝুঁকি তৈরি করে, সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক তা উপলব্ধি করে এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশা পূরণ অনেকটাই সহজ হবে।

লেখক: প্রকাশ ঘোষ বিধান; সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে