শ্রীমঙ্গলের লাল শাপলার বিলে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ঢল

এফএনএস (আতাউর রহমান কাজল; শ্রীমঙ্গল, মৌলভী বাজার) : | প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৪:৩৬ পিএম
শ্রীমঙ্গলের লাল শাপলার বিলে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ঢল

একসময় অচেনা, অবহেলিত জলাভূমি; আজ শ্রীমঙ্গলের সবচেয়ে আলোচিত পর্যটনকেন্দ্র। শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুরের লাল শাপলার বিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এমন মোহনীয় ছবি উপহার দিচ্ছে যে, প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখর হয়ে উঠছে পুরো এলাকা। ফুটন্ত শাপলার এই অপরূপ রাজ্য নিসর্গ প্রেমীদের কাছে এখন এক অনন্য ঠিকানা।

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ঠিকানা শ্রীমঙ্গল। চা-বাগানের নিসর্গ, পাহাড়-টিলা, হাইল-হাওরের জলাভূমি-সব মিলিয়ে সারা বছরই এখানকার টান থাকে আলাদা। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় গন্তব্য এখন শ্রীমঙ্গলের লাল শাপলার বিল। ভোরের আলো ফুঁড়ে ফুটে থাকা হাজারো লাল শাপলার সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিলটি কয়েক বছর আগেও ছিল সম্পূর্ণ অচেনা। স্থানীয় কৃষক ও জেলেদের নিত্যদিনের চেনা জলাভূমি ছাড়া এর কোনো পরিচিতি ছিল না। কিন্তু প্রকৃতির নিজের সজ্জায় বিলজুড়ে যখন ফুটল অসংখ্য লাল শাপলা, তখনই বদলে গেল এলাকার পরিচিতি, বদলে গেল মানুষের দৃষ্টি। এখন এটি শুধু একটি বিল নয়-এটি এক অপার লাল শাপলার রাজ্য।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও এই বিলটি ছিল অচেনা ও অবহেলিত। মৌসুমে মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া এর কোনো আলাদা পরিচিতি ছিল না। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া হাজারো লাল শাপলা একসময় যখন পুরো বিলজুড়ে বিস্তার লাভ করে, তখনই বদলে যায় এলাকার গল্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর থেকেই পর্যটকদের ঢল নামে শ্রীমঙ্গলের এই প্রত্যন্ত এলাকা মির্জাপুরে।

প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয় পর্যটকের আনাগোনা। প্রথম সূর্যের আলো যখন হাওরের জলে পড়ে, তখন শাপলাগুলো পুরোদমে ফুটে ওঠে। সেই সময়টিই সবচেয়ে মোহনীয়। শত শত লাল পাপড়ি একসঙ্গে পানির ওপর দুলতে থাকে বাতাসের হালকা ছোঁয়ায়। দূর থেকে দেখতে মনে হয়, যেন পুরো বিলটিই লাল রঙের নরম কার্পেটে মোড়ানো।

শাপলার পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকা প্রতিটি ফুলের রঙ এতটাই উজ্জ্বল যে দর্শনার্থীদের কেউই মোবাইল বা ক্যামেরায় ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। বাইক, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস-যে যা পারে নিয়ে ছুটে আসছেন এই লাল শাপলার মায়াময় দৃশ্য দেখতে।

মির্জাপুর ইউনিয়নের এই প্রত্যন্ত এলাকাটি একসময় ছিল নিস্তব্ধ। কিন্তু শাপলার সৌন্দর্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিদিনই এখানে ঢল নামে হাজারো মানুষের। স্থানীয় তরুণেরা কেউ শুরু করেছেন নৌকা ভাড়া দেওয়া। মির্জাপুর বাজারের খাবার হোটেল, চায়ের দোকানগুলো সরগরম। এতে এলাকার অর্থনৈতিক চিত্রে এসেছে পরিবর্তন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, শাপলা দেখার মৌসুমে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের ভিড়ে সারা এলাকা মুখর হয়ে ওঠে। বিল পরিদর্শনে আসা অনেকেই জানিয়েছেন, দেশের অনেক জায়গায় লাল শাপলা দেখা গেলেও শ্রীমঙ্গলের শাপলা বিলে রয়েছে ভিন্ন রূপ। চারপাশ জুড়ে হাওর, মাঝখানে প্রসারিত বিল, আর তার বুকে ফুটে থাকা শাপলার আগুনরাঙা সমারোহ-এ দৃশ্য হৃদয়ে চিরদিনের মতো জায়গা করে নেয়।

ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা মেহেরুননেছা ইসলাম জেরি নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এত কাছ থেকে এমন সৌন্দর্য কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে পুরো বিলটাকে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এই লাল শাপলার বিল শ্রীমঙ্গলের নতুন পরিচয়ের পাশাপাশি এলাকাটিকে টেকসই প্রকৃতি-পর্যটনেরও সম্ভাবনাময় গন্তব্য করে তুলেছে। সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।

শ্রীমঙ্গলের লাল শাপলার বিল এখন শুধু একটি সৌন্দর্যের স্থান নয়-এটি মানুষের ভালোবাসা, বিস্ময় আর প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতার প্রতীক। ভোরের আলোয় যখন শাপলাগুলো ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে, তখন মনে হয়-প্রকৃতি যেন নতুন দিনের জন্য সাজছে নতুন করে।

প্রতিদিনের ভিড়ে পরিষ্কার হয়ে যায় একটাই কথা-প্রকৃতি যতদূর সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিক, মানুষ তা দেখতে ছুটে আসবেই। আর শ্রীমঙ্গলের এই শাপলা বিল সেই সৌন্দর্যেরই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে