চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পণ্য পরিবহনে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে বাধ্য হয়েই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। যদিও দেশব্যাপী পণ্য পরিবহন ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হচ্ছে রেলপথ। আর ওই কারণেই বড় আকারের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্য, জ্বালানি, অবকাঠামো নির্মাণের কাঁচামাল ও খাদ্যশস্য পরিবহনে অন্যতম প্রধান মাধ্যম রেলওয়ে। কিন্তু যাত্রীবাহী সার্ভিসকে বেশি গুরুত্ব এবং ইঞ্জিন সংকটে কয়েক বছর ধরেই চাহিদা অনুযায়ী রেলপথে পণ্য পরিবহনে সেবা দিতে পারছে না। অথচ রেলওয়ের একমাত্র পণ্যবাহী ট্রেনই লাভ করে। কিন্তু বর্তমানে পণ্য পরিবহন খাত থেকে আয় কমে যাওয়ায় আরো ভারী হচ্ছে রেলের লোকসানের পাল্লা। আর বিপুল চাহিদার পরও পণ্য পরিবহনের সার্ভিস দিতে না পারায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে সরে যাচ্ছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলপথে জ্বালানি ও আমদানি-রফতানির কনটেইনার সবচেয়ে বেশি পরিবহন হয়। মূলত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশের আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশের বেশি হয়ে থাকে। যে কারণে সবচেয়ে বেশি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করে পূর্বাঞ্চল রেলের মিটার গেজ রেললাইনে। কিন্তু ইঞ্জিন স্বল্পতার কথা বলে রেলওয়ে সার্ভিস পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে দিনের পর দিন। ফলে বন্দর এলাকায় পণ্য আটকে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের পরিবর্তে লোকসান হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সামপ্রতিক সময়ে রেলের পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিসের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিকল্প নিয়ে ভাবছে। রেলের কাছে কয়েক মাস আগেও সিলেটের শাহজালাল সার কারখানা থেকে উত্তরবঙ্গের জন্য ২০ হাজার টন সার পরিবহনের প্রস্তাব ছিল। দীর্ঘদিন ধরে রেলের পরিবহন দপ্তরে বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনের সংশি।লষ্ট কর্মকর্তারা দেনদরবার করেও রেলে করে সার পাঠাতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ওসব সার সড়কপথে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানো হয়েছে। আর সড়কপথে পরিবহনে সময় ও অর্থ দুটোই বেশি ব্যয় হওয়ায় সরবরাহ করা সারের মূল্য বেশি পড়েছে। একইভাবে রেলপথে দেশের উত্তরবঙ্গে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য পরিবহনের একাধিক বড় প্রস্তাব এলেও রেলওয়ে কোনোভাবেই ট্রেন সার্ভিস দিতে পারছে না। ফলে রেলের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমূল্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ।
সূত্র জানায়, রেলপথে একসময় নিয়মিত ঘটনা ছিলো পাথর, সার, খাদ্যশস্য পরিবহন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো রেলপথকেই প্রাধাণ্য দিতো অবকাঠামো নির্মাণের কাঁচামাল, খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে। কারণ সড়কপথে পরিবহন ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিবহনের সময় পথিমধ্যে চুরি-ডাকাতির ঝুঁকি থাকে। যে কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে ব্যবসায়ীরা রেলপথেই নিরাপদে পণ্য পরিবহন করতে চায়। কিন্তু চাহিদা থাকলেও সার্ভিস দিতে না পারায় গ্রাহকরা রেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়র পূর্বাঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে কমছে পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিস। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেলওয়ে ৪ হাজার ২৭৩টি পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার্ভিসের সংখ্যা ৮৮৬টি কমে ৩ হাজার ৩৮৭টিতে নেমে এসেছে। আর সর্বশেষ চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে মাত্র ২ হাজার ৮৫টি পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিস চালানো হয়েছে। অর্থাৎ এ বছর সার্ভিসের সংখ্যা আরো কমেছে। এ ধারা চলতে থাকলে রেলের পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিস কয়েক বছরের মধ্যে অর্ধেকে নেমে আসবে।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-নভেম্বর পর্যন্ত রেলওয়ে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে কোনো ট্রেন পরিচালনা করতে পারেনি। একসময় ১৫০-২০০ কনটেইনার ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করলেও বর্তমানে সেটি ৮০-৮৫টির মধ্যে নেমে এসেছে। আগে প্রতি মাসে শতাধিক জ্বালানিবাহী ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করলেও এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তার মধ্যে নভেম্বরে জ্বালানিবাহী ট্রেন চলাচল করেছে মাত্র ২২টি। যদিও রেলওয়ে চলতি বছরের মার্চে ১১৫টি ও জুলাইয়ে ১০৯টি জ্বালানিবাহী ট্রেন পরিচালনা করেছিল। কয়েক বছর আগেও প্রতি মাসে ২০-২৫টি খাদ্য, সার, পাথরসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রেন পরিচালনা করতো রেলওয়ে। বর্তমানে নিয়মিত এ খাতের পাঁচ-সাতটি ট্রেন চলছে। যদিও সর্বশেষ কয়েক মাস রেলওয়ে এ ধরনের কোনো ট্রেন চালাতে পারেনি।
এদিকে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের মতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন পণ্যবাহী ট্রেন খাতে ১৯টি ইঞ্জিনের চাহিদা রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ইঞ্জিনের সরবরাহ কমাতে কমাতে চার-পাঁচটিতে নেমে এসেছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে তীব্র ইঞ্জিন সংকটের কারণে পণ্য খাতে ইঞ্জিনের সরবরাহ কমাতো বাধ্য হচ্ছে রেলওয়ে। পাশাপাশি নতুন নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা, যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হলে পণ্যবাহী ট্রেনের জন্য বরাদ্দ ইঞ্জিন সরিয়ে নেয়ার কারণে পণ্য খাতে রেলের সার্ভিস স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন সময়ে পণ্য খাতে ইঞ্জিন সরবরাহ বাড়িয়ে ট্রেন সার্ভিস চালু করতে রেলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করলেও এর সুফল মিলছে না। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে রেলওয়েকে কনটেইনার সার্ভিস বৃদ্ধি করতে তাগাদা দিলেও রেলওয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না। এতে কমলাপুর আইসিডিমুখী কনটেইনার সার্ভিস কমে যাওয়ায় বড় ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন জানান, রেলওয়ে সবসময় যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিস চালু রাখতে চায়। তবে দীর্ঘদিন ইঞ্জিন আমদানি না হওয়ায় সংকট বেড়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের টিকিট ১১ দিন আগে বিক্রির কারণে ওসব ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা কঠিন। ওই সার্ভিস নিয়মিত রাখতে পণ্যবাহী ট্রেনের সার্ভিস পিছিয়ে দেয়া হয়। তবে রেলওয়ে বেশকিছু ইঞ্জিন মেরামত করার পাশাপাশি নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে বেশকিছু ইঞ্জিন আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে অচিরেই যাত্রীবাহী ট্রেনের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিসও।