টাকা নাকি ক্ষমতা-কোনটিতে আকৃষ্ট হচ্ছে মেধাবীরা? উত্তরটি স্পষ্ট-ক্ষমতার দিকে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৫তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে শীর্ষ তিনজনই ডাক্তার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলছে- পেশা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবাই স্বাধীন। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অন্য পেশায় কেন যাবে? এমন প্রশ্ন তোলাও ঠিক না।
কিন্তু ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো কঠিন বিষয় পড়ে তারা কেন অন্যদিকে ঝুঁকছে- সেটা অনুসন্ধান করা জরুরি। সবার পুলিশ বা প্রশাসক হতে চাওয়ার অন্তরালে আসলে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?
ডাক্তারির মতো মানবিক ও সচ্ছল পেশা ছেড়ে যারা পুলিশ বা প্রশাসনে যায়, তারা কোন যুক্তিতে যাচ্ছে? এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হওয়া উচিত। দেশের কোনো প্রশাসক বা পুলিশ অফিসার বৈধভাবে একজন ডাক্তারের চেয়ে বেশি আয় করতে পারেন না। পরিচিত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে লাখ টাকা উপার্জনে কয়েক ঘণ্টাই যথেষ্ট।
তাই ডাক্তাররা অর্থের জন্য পেশা বদলাচ্ছেন- এই যুক্তি ধোপে টেকে না। এখানে নিশ্চয়ই অন্য কারণ আছে- যা চিহ্নিত না করলে এই প্রবণতা কমবে না বরং বাড়বে।
একজন মেধাবী মেডিক্যাল শিক্ষার্থী অন্য পেশায় গেলেও, সে ডাক্তার হিসেবেও তুখোড় হতো। পুলিশ বা প্রশাসনে যেতে হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কঠিন পাঠ্যক্রম শেষ করা বাধ্যতামূলক ছিল না; তুলনামূলক সহজ কোনো বিষয়ে পড়েও সে পুলিশ/প্রশাসন/পররাষ্ট্র/কাস্টমস ক্যাডারে যেতে পারত।
আমি কোথাও বলছি না ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার প্রশাসনে গেলে খারাপ করবে- বরং তাদের ভালো করার সম্ভাবনাই বেশি। তবে প্রশ্ন হলো- যে বিপুল ব্যয়ে রাষ্ট্র একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে, সেই সমপরিমাণ সুবিধা কি ঢাবি বা রাবির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী পায়? ডাক্তার হতে গিয়ে ল্যাব, ওটি-ওয়ার্ড এবং ইন্টার্নশিপের কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়, মানবিকের শিক্ষার্থীর সনদ অর্জনে এসবের কিছুই লাগে না।
চিকিৎসায় আমরা বিদেশনির্ভর। জটিল রোগে ধনীরা সিঙ্গাপুর-লন্ডনে যায়, মধ্যবিত্ত ভারত-চীনমুখী হয়, আর উপায়হীনরা সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। মেধাবী ডাক্তাররা যদি আদি পেশা ছেড়ে চলে যায়- তবে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা অমেরুদণ্ডী হয়ে যাবে।এত কষ্টের পড়াশোনা শেষে এমবিবিএস করা কেউ পুলিশ হলে অনেকেই খুশি হয়- কিন্তু ডাক্তারি ছেড়ে চোর-ডাকাত ধাওয়া দিতে যেতে হয় কেন?- সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
বেনজির, মনিরুল, হারুন, বিপ্লব কিংবা বনজ কুমারদের যে আদর্শে সমাজ গ্রহণ করেছে, সেই আদর্শে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দিলিপ কুমার রায়, নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মো. মোসাররফ হোসেন, গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. আনজুম আরা বেগম অথবা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ও ডা. মাহবুব-ই-খোদাকে গ্রহণ করেনি। অথচ একজন ডাক্তারের কারণে কত অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়, কত রোগী মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে, কত পরিবার ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচে- এ নিয়ে সমাজে কি কোনো আলোচনা আছে? ডাক্তারদের যে সম্মানের আসনে ওঠার কথা ছিল- রাষ্ট্র ও জনগণ কি তা নিশ্চিত করতে পেরেছে?
ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার শুধু পুলিশ/প্রশাসনেই নয়- বাংলাদেশ ব্যাংকেও যোগদানের নজির আছে। বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার এমবিএ করছে- অন্য পেশায় যাওয়ার জন্য। রাষ্ট্র কি ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পেরেছে? দেশের অবকাঠামো নির্মাণে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের আধিক্য কেন? রাজনৈতিক হর্তাকর্তাদের অনেকেই সামান্য সর্দি-জ্বরেও বিদেশে চিকিৎসা নেন কেন?
সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ কি আদৌ সুস্থ মানুষের থাকা ও চিকিৎসা গ্রহণের উপযোগী? যেখানে ডাক্তাররা প্রতিদিন কাজ করেন সেটা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে? অথচ একই দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।
ডাক্তারদেরকে ডাক্তারিতে ধরে রাখার ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা পেশা বদলাচ্ছে- তারা ডাক্তার হিসেবেও প্রমিজিং হতো। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ভরযোগ্য করতে ডাক্তারদের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, সম্মান ও সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে। টাকার জন্য নয়- ডাক্তাররা অন্য পেশায় যায় নানান কারণে। সেই কারণগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা করা জরুরি।
সবাই মূলে থাকবে না- একথাও সত্য। ডাক্তার সাহিত্যিক হবে, ইঞ্জিনিয়ার ফটোগ্রাফার হবে। শখ, পছন্দ ও রুচিতে বিচিত্রতা থাকবে। যার যেখানে ভালো লাগে, সুন্দর সময় কাটে এবং মন টানে- সে সেটাকেই বেছে নেবে। এখানে বাধ্যবাধকতা বা জোড়াজুড়ির সুযোগ নাই। সংবিধান এই অধিকার প্রত্যেক নাগরিকে দিয়েছে- যা প্রশংসনীয়। কিন্তু গণহারে ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা ভিন্ন বার্তা বিদ্যমান। কর্তৃপক্ষকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখতে হবে। আইন পড়ে জজ ব্যারিস্টার হওয়া যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, মেডিসিনে পড়ে ডাক্তারি করা তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অধিক মানবতার প্রশ্ন ও মানবিকতার চিত্র সংশ্লিষ্ট। জনতার কাছে ডাক্তার ভগবানের মত মর্যাদা পায়; পুলিশ-প্রশাসনের কেউ সেটা পায় কি-না জানা নেই।
লেখক: রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক