বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে ঘিরে যে সম্ভাবনা বহুদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে, তা আজও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আমাদের হাতে রয়েছে, অথচ এগুলোকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আকর্ষণীয় ব্র্যান্ডে রূপান্তর করার মতো পরিকল্পিত উদ্যোগ দেখা যায় না। বৈশ্বিক পর্যটনে এশিয়ার উত্থান এখন স্পষ্ট। মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, নেপাল কিংবা ভিয়েতনাম পর্যটকবান্ধব নীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আগ্রাসী বিপণনের মাধ্যমে নিজেদের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো আঞ্চলিক র্যাংকিংয়ের শেষ সারিতে অবস্থান করছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স ২০২৪ অনুসারে ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেনি, বরং অবনতি হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ভিসা জটিলতা, দুর্বল অবকাঠামো, পরিকল্পনাহীন বিপণন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা জনিত ভ্রমণ সতর্কতা। অন্যদিকে মালদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো ভিসা সহজীকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে। বাংলাদেশে ট্যুর অপারেটররা দীর্ঘদিন ধরে ই-ভিসা চালুর দাবি জানালেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য এবং ভিসা সুবিধার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি এখনো আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারেনি। এর ফলে ২০২৪ সালে বিদেশি পর্যটন আয় কমেছে, বুকিং কমেছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। এমনকি কক্সবাজারের মতো সম্ভাবনাময় গন্তব্যও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্থগিত হওয়ায় পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছতে পারেনি। অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে সেন্ট মার্টিন বা সাজেকের মতো জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন টেকসই ও সমন্বিত উদ্যোগ। ইকোট্যুরিজম মডেলের ওপর জোর দিয়ে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে অংশীদার করতে হবে। বেসরকারি খাত ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু আস্থার সংকট কাটাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি নীতি, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ অপরিহার্য। পর্যটন শুধু অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে না, এটি একটি দেশের ভাবমূর্তি, সংস্কৃতি ও মানবিক বিনিময়ের শক্তিশালী মাধ্যম। এখনই সময় বাংলাদেশকে পর্যটনে নতুন চোখে দেখার। সঠিক নীতি, সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনায় আমরা সহজেই হয়ে উঠতে পারি দক্ষিণ এশিয়ার পরবর্তী সাফল্যের গল্প।