প্রতিনিয়ত কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে, অথচ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। চালু কলকারখানাও একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তিন শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকারের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। শিল্প-বিনিয়োগের এমন দুরবস্থার পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং ঋণপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মুদ্রাস্ফীতি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটসহ আরো অনেক কারণেই দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধুঁকছে। সাধারণত উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির মতো প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলো প্রথমে শক্তিশালী শিল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চ কর্মসংস্থান ও মাথাপিছু আয় নিশ্চিত করে, এরপর সেবা খাতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান অর্জনের আগেই উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতিগত অসংগতির প্রতিফলন। উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের অভাব ও আমদানির ওপর বাড়তি নির্ভরতা এর অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্প বা উৎপাদন খাতে এ ধরনের পতন দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কারণ শিল্প বা উৎপাদন খাত ঐতিহ্যগতভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং রফতানি প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শিল্প খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের শিল্প খাত পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর একটি খাত। এ খাতের সমপ্রসারণ ও উন্নয়নে প্রয়োজন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ও মূলধন। দেশী বিনিয়োগ ও মূলধনের অন্যতম উৎস ব্যাংক ঋণ। কয়েক বছর ধরেই দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংক সুদহারও বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। উচ্চ খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে থাকা অনেক ব্যাংক এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে। যা বেসরকারি খাতের বিপরীতে এক অসম চাপ তৈরি করছে। এ অবস্থাকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ‘ক্রাউডিং আউট’, যেখানে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থায়নের জায়গা সংকুচিত হয়। ব্যাংকিং খাতের এ সংকট সরাসরি মুদ্রানীতির লক্ষ্যকেও ব্যাহত করছে। উচ্চ সুদ, সীমিত ঋণ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসায়ীরা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে দেশকে রপ্তানিমুখর করতে হলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে হলে এলসি মার্জিন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাটা আরও সহজ করে দিতে হবে। ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে দিতে হবে। ট্যাক্সের বিষয়টিকে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়াতে হবে।