স্বাদের দিক থেকে একেবারেই আলাদা। একবার মুখে দিলে মিষ্টির সরল স্বাদ অনেকক্ষণ লেগে থাকে। যেন পুরোনো দিনের সেই খাঁটি সন্দেশের অনুভূতি। এভাবেই ৫৩ বছর ধরে মানুষের মন জয় করে আসছেন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের তপন চন্দ্র দে। তিনি তৈরি করেন এমন এক ধরনের সন্দেশ,যার স্বাদ আজও বদলায়নি। সেই ১৯৭২ সালে শুরু করা সেই প্রথম দিনের মতোই। সময় বদলেছে, বাজার বদলেছে, মিষ্টি বানানোর পদ্ধতি বদলেছে কিন্তু তপনের সন্দেশের স্বাদ বদলায়নি একটুও।
উপজেলার গোবিন্দপুর বাজারের এক কোণে তপনের ছোট দোকান। না আছে বড় সাইনবোর্ড, না আছে আধুনিক সাজসজ্জা। তবুও সকালে দোকান খোলার পর থেকেই সেখানে মানুষের ভিড় লেগে থাকে। কেউ ৫টি, কেউ ১০টি, কেউবা আধা কেজি কিংবা ২৫০ গ্রাম করে কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। অনেকেই আবার দেশের বাইরে থাকা সন্তান বা আত্মীয়দের জন্যও পাঠান বিশেষ এই সন্দেশ।
দোকানে ভিড় দেখলে বোঝা যায়, স্বাদই মানুষের সবচেয়ে বড় অনুভূতি। আর সেই স্বাদ ধরে রেখেছেন তপন চন্দ্র দে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। তিনি জানান,১৯৭২ সালে প্রথম বানাই। তখন দাম ছিলো ২৫ পয়সা। এখন দাম বেড়েছে, কিন্তু স্বাদ একই। ছানা আর চিনির মাপটাই সব।
পরিশ্রমে গড়া অনন্য স্বাদ ছানা, চিনি এবং অল্প এলাচ এই তিনটি সহজ উপাদান থেকে তৈরি হয় তার বিখ্যাত সন্দেশ। তবে তৈরি প্রক্রিয়া মোটেই সহজ নয়। দুধ ছেঁকে ছানা তৈরি করা থেকে শুরু করে ছানাকে শুকানো, ভাজা, মিশ্রণ তৈরি, আকার দেওয়া,সবই করতে হয় সম্পূর্ণ হাতে। তপন বলেন, মেশিনে করলে হয়তো সময় কম লাগতো। কিন্তু তাতে এই স্বাদ পাবেন না। হাতের কাজই আসল।
এমন পরিশ্রমের কাজ হওয়ায় আজ পর্যন্ত কাউকে তিনি ঠিকমতো শিখিয়ে গড়ে তুলতে পারেননি। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে শুরু করলেও কয়েকদিনের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেন। বয়স বাড়লেও কমেনি নিষ্ঠা
৮ম দশকে পা রাখা তপন চন্দ্র দে এখন আগের মতো দ্রুত কাজ করতে পারেন না। তবুও প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ কেজি সন্দেশ বানানোর চেষ্টা করেন। তার স্ত্রী পাশে থেকে সহযোগিতা করেন সব কাজে। এক কেজিতে প্রায় ৭৫-৮০টি সন্দেশ হয়। দাম ৪০০ টাকা। প্রতি পিস ৫ টাকা। লাভ থাকে প্রতি কেজিতে প্রায় ১০০-১২০ টাকা।
তিনি আরও জানান, বয়স হয়েছে। হাত কাঁপে। তবুও চেষ্টা করি মানুষ যেন আগের মতোই স্বাদ পায়। লাভ কম, কিন্তু তাতে সমস্যা নেই। মানুষের ভালোবাসাই লাভ।
গোবিন্দপুর বাজারের পল্লী চিকিৎসক রাজু মিয়া বলেন,শৈশবে যে স্বাদ পেয়েছিলাম, এখনো ঠিক একই স্বাদ পাই। তপন দাদার মতো এতো বছর এক স্বাদ ধরে রাখা বড় বিষয়।
বাজারের মুদি দোকানি দেলোয়ার হোসেন বলেন,অনেকেই বলে শহরের নামী দোকানের মতো সাজসজ্জা কেন করেন না? আমি বলি তপন দার দোকানে সাজসজ্জার দরকার নেই, তার সন্দেশই সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
বিদেশে থাকা সন্তানের কাছে সন্দেশ পাঠাবেন বলে সন্দেশ কিনতে এসেছেন স্থানীয় কৃষক রফিক উদ্দিন। তিনি বলেন, আমার ছেলের খুব পছন্দ। দুবাইতে পাঠাই মাঝেমধ্যে। সে বলে এই সন্দেশ বিদেশেও আলাদা স্বাদের।
দুধের দাম বাড়া কিংবা কমা, চিনি,এলাচের দামের ওঠানামাসহ নানা কারণে সন্দেশ বানানোতে খরচ বাড়ছে। কিন্তু তপন চন্দ্র দে দাম বাড়াতে রাজি নন। তিনি বলেন, আমার গ্রাহক সবাই সাধারণ মানুষ। দাম বাড়ালে কষ্ট হবে। তাই যতটা সম্ভব আগের মতোই রাখি।
স্থানীয় ছাত্র নাফিস জানান,অতিথি এলেই মা আগে তপন দাদার সন্দেশ আনেন। ছোট থেকে খাচ্ছি। ৫৩ বছর একস্বাদে মানুষকে মুগ্ধ করে যাওয়া সহজ কাজ নয়। তপন চন্দ্র দে সেটা সম্ভব করেছেন একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রম দিয়ে। তবে একজন নতুন কারিগর তৈরী হলে তপন সাহেবের সন্দেশের ঐতিহ্য টিকে থাকতো।