গত আট বছরে শ্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বেশিরভাগ মামলা প্রত্যাহার করেছে সরকার। ফলে অভিযুক্ত ও অজ্ঞাতনামাসহ মোট ৪৭ হাজার ৭২৮ জন শ্রমিক মামলার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তবে শ্রমিক হত্যার অভিযোগে দায়ের হওয়া গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানার একটি মামলা এখনও চলমান রয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও গাজীপুর জেলার ছয়টি থানায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মোট ৪৫টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে আশুলিয়া থানায় সর্বাধিক ১৫টি, কালিয়াকৈরে ১৪টি, কোনাবাড়ীতে ১০টি এবং জয়দেবপুর, বাসন ও টঙ্গী পশ্চিম থানায় দুটি করে মামলা হয়। এ মামলাগুলোর মধ্যে ৪১টি দায়ের হয়েছিল ২০২৩ সালে, আর বাকি চারটি ২০১৫ ও ২০২১ সালে। সরকারি নথিতে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে শ্রমিকনেতারা দাবি করছেন, অধিকার আদায়ের আন্দোলনের কারণেও অনেক মামলা হয়েছিল।
মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া
২০২৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে মামলাগুলো প্রত্যাহারের আবেদন জানায়। এটি আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (আইটিইউসি)-এর সদস্য সংগঠন। এরপর ২৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে মামলাগুলো প্রত্যাহারের সুপারিশ করে।
প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তেমন উদ্যোগ না নিলেও পরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রমিক সংগঠন এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর বৈঠকের পর বিষয়টি গতি পায়। শেষ পর্যন্ত শ্রম, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ বৈঠকে মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়।
কারা দায়ের করেছিল মামলা
মামলাগুলোর মধ্যে ১১টির বাদী ছিল পুলিশ। বাকি ৩৪টি মামলা দায়ের করেন বিভিন্ন কারখানার নিরাপত্তা কর্মকর্তা, মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা, নির্বাহী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং আইন উপদেষ্টা। অধিকাংশ মামলায় অভিযোগ ছিল বেআইনি সমাবেশ, বিশৃঙ্খলা, হামলা ও শ্রমিক অসন্তোষ।
একেকটি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ছিল হাজারে। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর কোনাবাড়ী থানার একটি মামলায় ৭ হাজার অজ্ঞাতনামা শ্রমিককে আসামি করা হয়। মামলার বাদী তৎকালীন এসআই সানির হাসান খান স্বীকার করেন, বসদের নির্দেশেই মামলা করা হয়েছিল।
চলমান মামলা
সব মামলার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি মামলা এখনও প্রত্যাহার হয়নি। ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া মামলায় নয়জন নামীয় শ্রমিক ও ৮০০ অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে একজন শ্রমিক নিহত হন। মামলার বাদী ছিলেন অনন্ত গ্রুপের কারখানা এ বি এম ফ্যাশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তার বলেন, সব মামলা রাজনৈতিক ছিল না। অধিকার আদায়ের আন্দোলনের কারণেও মামলা হয়েছিল। তবে বর্তমান সরকারের উদ্যোগকে তিনি প্রশংসনীয় উল্লেখ করেন, যা রাজনৈতিক সরকারের জন্য কঠিন ছিল।
অন্যদিকে সদ্য অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান মন্তব্য করেন, মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসার পেছনেও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল আলম জানান, কিছু মামলার প্রত্যাহারের সত্যায়িত কপি তারা ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছেন এবং বাকি মামলার কপি তোলার প্রক্রিয়া চলছে।