কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমন একটি বিশেষ জাতের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও পৃথিবীর বড় বড় খ্যাতিমান লেখক, কবি, গবেষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী বন্ধু বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে নানা উক্তি করে গেছেন। বন্ধু নিয়ে তৈরি হয়েছে গান, কবিতা বা সিনেমা।
বাস্তব জীবনেও প্রকৃত বন্ধত্বের বা বন্ধুত্বের সুযোগে ক্ষতি করার বহু উদাহরণ রয়েছে। আমাদের প্রত্যহ চলার পথে যে সবথেকে বেশী সময় সঙ্গ দেয় সে বন্ধু। তাই খাঁটি বন্ধু প্রতিটি মানুষের জীবনেই আবশ্যক। মহান দার্শনিক এরিষ্টটল বলেছেন, দুর্ভাগ্যবান তারাই যাদের প্রকৃত বন্ধু নেই। আবার তিনিই বলেছেন বন্ধু হলো এক আত্মার দুটি শরীর অথবা প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয় কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয় ততই উৎকৃষ্ট হয়। এসব মন্তব্যের অর্থ হলো বন্ধত্ব নামক সম্পর্কটি চির নতুন, চির উদ্দীপনায় ভরা, চির সুখময়। তবে তা যদি প্রকৃত বন্ধুত্ব হয়। কারণ আজকাল সবকিছুর মধ্যেই যে হারে ভেজাল ঢুকে গেছে বন্ধত্ব নামক এই সম্পর্কটিও গুটি কয়েক কুবন্ধুর কারণে কুলষিত হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমরা দুই বন্ধু ও ভাল্লুকের গল্পটা জানি। যেখানে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে রেখেই নিজে বাঁচার তাগিদে গাছে উঠে পরে। যদিও অন্য বন্ধু তাৎক্ষণিক বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায়। কিন্তু এই গল্পটার মোরাল হলো বিপদের সময় যে বন্ধু তোমাকে ত্যাগ করে সে প্রকৃত বন্ধু নয়। তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই উত্তম। এ ধরনের বিপদেও সময় গাছে উঠে যাওয়া বন্ধু বা গাছে তুলে মই টান দেওয়া বন্ধু আমাদের সমাজে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কথায় কথায় আমরা বলি সৎসঙ্গে স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। বন্ধু শব্দটি খুব ছোট কিন্তু এর অর্থেও ব্যাপকতা সিমাহীন। কোন সুনির্দিষ্ট গন্ডীতে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। সে চেষ্টা করা কেবল অর্থহীন শক্তির অপচয় মাত্র। বন্ধু মানে একে অপরের সুহৃদ। দুটি হৃদয় যখন সকল সংকীর্ণতা, সকল হিংসা, কপোটতা, সকল ক্রোধ মুক্ত হয়ে একত্র হয়, পাশে থাকে, পরামর্শ দেয় সেই বন্ধু। সেই হাত প্রকৃত বন্ধুত্বের হাত। যা সারাজীবন বাড়িয়েই থাকে।
এখন প্রশ্ন কে বন্ধু হতে পারে? এরা কি পরিবারের বাইরের হতে হবে? আসলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে কেউ তোমার বন্ধু হতে পারে। সে তোমার মা বাবাও। আর সত্যি কথা বলতে মা বাবাই তো সন্তানের সবথেকে কাছের, সবথেকে প্রিয় এবং উৎকৃষ্ট বন্ধু।
ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের চারদিকে আজ অশান্তির অনল। এই অনলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে আমাদের সবাই। চারিদিকে হানাহানি, অবিশ্বাস, প্রতিশোধের নেশা, একে অপরকে আক্রমণ করার মনোভাব এসব বিরাজ করছে। শান্তির জন্য সবাই কেমন মরিয়া হয়ে ছুটছে। প্রত্যেকেই সুখের খোঁজ পেতে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সুখ পাচ্ছে কি? সংকীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে সুখ খোঁজার বৃথা এই চেষ্টা। তবুও আমরা ছুটছি। থেমে থাকারও তো কোন উপায় নেই। এত কিছুর মধ্যে সন্তানকে মানুষ করার বিষয়টি যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে মা বাবার জন্য। নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেও যেন মানুষ হবার বিষয়টি অসম্পূর্ণই থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ভাল ফলাফল যেন অনেক সময় পরিহাস করছে। তাছাড়া ব্যস্ততায় ঘেরা জীবনে মা বাবার সাথে সন্তানদের দুরত্ব বেড়েই চলেছে। প্রয়োজনের তাগিদে দুজনেই যখন চাকুরীরত সন্তান তখন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগেই বলেছি মা বাবাই সন্তানের সবথেকে কাছের বন্ধু। সন্তানের মনের কথা তাদেও জানতেই হবে। কিন্তু তারা ব্যার্থ হচ্ছে। শিশুকাল থেকেই মা সন্তানের সবথেকে কাছে থাকে। সন্তান কেন কাঁদে তা জানার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, আবার হাসলে ঠিক তার কারণ খুঁজে বের করে ঠিক এমনিভাবেই বড় হলেও সন্তান কি চায় সেই মনের কথা একজন ভাল বন্ধু হয়েই বুঝতে হবে। ধমকের স্বওে দূরে সরিয়ে রাখলে সেই দুরত্ব বাড়তে বাড়তে এত দূরত্ব তৈরি হবে যে কাছে আনাটা কষ্টকর হয়ে উঠবে।
বন্ধু হবারও যোগ্যতা থাকা দরকার। এই যোগ্যতা কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সার্টিফিকেটের যোগ্যতা নয়। এই যোগ্যতা কাছে আসার যোগ্যতা, অন্যকে বোঝার যোগ্যতা, ভালোবাসার যোগ্যতা এবং সর্বোপরি বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার ও বিশ্বাস করার যোগ্যতা। এই বিশ্বাসের ওপরই বন্ধুত্বের বাঁধন শক্ত হয়। যার বন্ধুর ওপর বিশ্বাস যত বেশি তারা তত ভালো বন্ধু। আমাদের কজনেরই বা আজ সে যোগ্যতা রয়েছে। আমরা তো কেবল স্বার্থ নিয়েই ব্যাস্ত থাকি। স্বার্থ ফুরালে চম্পট দেই। বন্ধুত্বের সুযোগে আঘাত করি। কিন্তু এই সমাজকে বাঁচাতে আজ নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের খুব দরকার। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধুর প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। তখন মানুষ হয় নিঃসঙ্গ। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন সময় সাহচর্য পাওয়া বন্ধুরা তখন কে কোথায় থাকে তা জানাও যায় না। অন্তর দিয়ে কেবল সে সময়ের স্মৃতি হাতরানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মনের কোণে সেই গান গুণ গুণ করে বাজে, ’কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই’।