পৃথিবীর সমস্ত শান্তিকামী, ন্যায়বাদী, সত্যানুরাগী, মানবতাবাদীরা ড. মুরসীর মৃত্যুতে শোকাভিভূত। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে তার প্রতি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিস্ফোরণম্মুখ। বিশ্বের সমস্ত খ্যাতনামা আলিম ইসলামিক স্কলারগণ রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার হওয়া মুরসির মৃত্যুতে এমন হৃদয়কাড়া অশ্র“সিক্ত তীব্র আবেগঘণ অকৃত্রিম শোকগাথা দিয়েছেন, যা ইতোপূর্বে কারো ব্যাপারে দেখা যায়নি। মুরসি পপুলার ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। মুরসির মৃত্যুতে ন্যায় সংগ্রাম ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে এক মহানায়কের বিদায় ও একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে মুরসি ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম শাসক, তা তার শত্র“ও অস্বীকার করতে পারবে না। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। স্বৈরশাসক সেনাপ্রধান সব বিরোধী মত তো বটেই, নিতান্ত জনস্বার্থমূলক ইস্যুতে কথা বললেও রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা নিয়ে এখনো ঝাঁপিয়ে পরে থাকে বুনো ষাঁড়ের মতো!
প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি গত ১৭ জুন মিসরের একটি আদালতের এজলাসে তার প্রতি অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতনের প্রতিবাদে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবশ্য এর আগে গত ৭ মে তিনি আদালতে বলেছিলেন, তার জীবন হুমকির মুখে। ২০১৩ সালে মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তাকে আর স্বাধীনভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। ৬ বছর নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটানো মুরসিকে মাত্র ৩ বার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
দেশটির একনায়ক সরকার এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক দাবি করলেও আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি উঠেছে। মুরসির মৃত্যু বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মিসরের বর্তমান সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। তার মৃত্যুর পর মানবাধিকার সংস্থা ও স্বাধীন পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মুরসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল তার সবই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যা অনেকেই ‘গুপ্তহত্যার’ সাথে তুলনা করছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মাদ মুরসিকে হত্যা করা হয়েছে এবং যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, মুরসি মারা যাননি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এসময় হত্যাকাণ্ডের জন্য এরদোয়ান মিশরের বর্তমান সিসি সরকারকে দায়ী করেন। এরদোয়ান বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আস-সিসির সরকারকে হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবেন তিনি। একই সঙ্গে মিসর সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসির প্রতি আহ্বান জানান।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি মাত্র ১ বছর দেশ পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। তারপর তারই নিয়োগ করা প্রধান সেনাপতি আল সিসি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে ঢুকিয়ে দেন। মিসরের কোনো আইনই তাকে চার দেয়ালের বাইরে আসতে দেয়নি। কারণ মিসরের মত বিশ্বের কিছু দেশে সময়ে সব আইনই চলে বিশেষ কোনো ইশারায়। ২০১৩ থেকে গত ৬ বছর অন্ধকার ও নির্জনতায় কেটেছে তার। আবার প্রমাণিত হল, মানুষ তার ভাগ্যের লেখাকে অতিক্রম করতে পারে না। ধর্মপ্রাণ মুরসি না পেলেন পার্থিব জীবনে সাফল্য, না পেলেন নিজ দেশে সুবিচার, না পেলেন আপনজনদের সাহচর্য। ১৯৭২ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন ও ইসরায়েলের পুতুল শাসকেরাই মিসরের ক্ষমতায় ছিলেন। বিপরীত স্রোত থেকে মুরসি আসায় তাকে হটাতে মার্কিন-ইসরায়েল জোট বরাবরই ছিলো সক্রিয়। মানুষের নির্বাচিত নেতা হয়েও জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে কাজ করার কারণেই মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি ও মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। আর তাই বিশ্ববিবেক, মানবতাবোধ তার কোনো উপকারে আসেনি।
মিসরের গণতন্ত্রকামী জনতারও আত্মসমালোচনা থাকা উচিত। মুরসির পদত্যাগের আন্দোলন করে তারা যে আগের চাইতে কঠোর সেনাশাসনের হাতে বন্দী হলেন, সে দায় কার? মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মুরসি হারান নাই কিছুই। বরং সেই সব লোকদের ভেবে দেখা উচিত, তারা জিতেছে কতটা, যারা বিক্ষোভ করেছিল মুরসির বিরুদ্ধে? মুরসির মৃত্যু যে গণতন্ত্রের জন্যই, তা অস্বীকার করা যাবে না। মুরসির মৃত্যুতে স্বৈরতন্ত্রের জয় হয়েছে; পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্রের!