পানির ধর্ম নিচের দিকে নামা বা প্রবাহিত হওয়া। আর যদি তা না পারে, তাহলে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হবেই। ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই। কাজেই বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টির ভারও রাজধানী বহন করতে পারবে না। আগে যেসব স্থানে সর্বোচ্চ গিড়া বা হাঁটু পানি দেখা যেত গত কয়েকবছর সেখানে কোমর থেকে গলা সমান পানি দেখা গেছে। অনেক স্থানে চলেছে নৌকাও।
বৃষ্টি গ্রীষ্মের টানা গরম থেকে আমাদের স্বস্তি দেয়। একাধারে ২ দিন বৃষ্টি না হলে, সর্বত্র হাহাকার পরে যায়। অথচ শহরে স্বাভাবিক একটু সৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। শীত মৌসুম শেষ হতে হতে ঢাকা যে মাত্রায় ধূলিধূসর হয়ে ওঠে, বাতাস যে পরিমাণ দূষিত হয়ে পড়ে; তখন বৃষ্টি শুধু মানুষই নয়, পশু, পাখি, মৎস্য, এমনকি বৃক্ষরাজির জন্যও আশীর্বাদ হয়ে আসে। ইতোপূর্বে ঢাকা নগরী বারবার বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় স্থান পেয়েছে। বৃষ্টি বায়ুদূষণ কমায়। গাছগুলো সবুজ হওয়ার জন্য বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। ঢাকা শহরের চারপাশের দূষণে কালো হয়ে যাওয়া নদীগুলোকেও বৃষ্টি প্রাণ দেয়। বর্ষার বৃষ্টিতে বিদ্যুতে ঘাটতি কমায় এবং ভূ-গর্ভস্থ্য পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আইন অমান্য করে শহরের খাল-পুকুর, জলাভূমি দখল ও ভরাট করা এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা ঢাকার পানিবদ্ধতার মূল কারণ। ঢাকায় ১২ শতাংশ জলাভূমি থাকার কথা থাকলেও নিম্নাঞ্চল ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাওয়ায় মাত্র ২ শতাংশ জলাভূমি রয়েছে। ঢাকায় ৬৫টি খাল ও ৪টি নদী ছিল। এগুলো নেই তার উত্তর কে দেবে? এছাড়া শহরের অধিকাংশ মাটি কার্পেটিং থাকার কারণে, পানি শোষণের ক্ষমতাও মাটির নেই। খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে পানি নদীতে চলে যাওয়ার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ঢাকার নাগরিক দুর্ভোগ ও সংকট নিরসনে এসব বিষয়ে নজর দেয়া এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার তাগিদ বরাবরই উচ্চারিত হয় নানা মহল থেকে। কিন্তু প্রভাবশালী দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ওয়াসা, ডেসা, তিতাস, বিটিসিএল, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ডে সমন্বয়সাধনের বাস্তব উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
আমাদের বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক মেয়াদ মে থেকে আগস্ট, এই চার মাস। এই সময়ের মধ্যে হালকা, মাঝারি, মাঝারি থেকে ভারী, আবার কখনো ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিও হয়ে থাকে। মৌসুম জুড়ে সব মাত্রার বৃষ্টি মিলিয়েই একটি স্বাভাবিক বর্ষা মৌসুম। এই স্বাভাবিক বর্ষার ধকল নেওয়ার ক্ষমতা ঢাকার মোটেই নেই।
প্রতিদিনই রাজধানীর জলাশয়গুলোর আয়তন কমছে। পানি প্রবাহ না থাকায় নিচু জমি, ঝিল, জলাশয় ও লেকগুলোর কচুরিপানা ও নোংরা আবর্জনায় একদিকে জন্মাচ্ছে মশা; অন্যদিকে এই ময়লা আবর্জনার কারণে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে নিষ্কাশন হতে না পেরে সৃষ্টি হচ্ছে পানিবদ্ধতার। যে কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবছর বর্ষাতে ঘণ্টায় মাত্র ৪০ মিলিমিলটার বৃষ্টিপাত হলেই রাজধানীতে পানিবদ্ধতা দেখা দিবে। আর বৃষ্টি কম হলে রক্ষা, না হয়তো ডুবন্ত ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ির কারণে, ঢাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়, প্রধান সড়ক থেকে অলিগলির ভেতরে। গুলিস্তান, শান্তিনগর, নিউমার্কেট, কারওয়ানবাজার, মিরপুর, মালবাগ, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ সব এলাকার একই অবস্থা। মেট্রোরেলের কারণে মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রায় ভঙগুর। তাই অল্প বৃষ্টিতেই পড়তে হবে পানিবদ্ধতায়। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় বছরজুড়ে এলোমেলো কাজ হলেও তা আসলে কোনো কাজে আসছে না।
১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন আইন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব পরে ঢাকা ওয়াসার ওপর। ফলে নর্দমাগুলো সচল রাখা ও পরিষ্কার করার দায়িত্ব ওয়াসার। এই নর্দমাগুলো বানানোর দায়িত্ব অবশ্য সিটি করপোরেশনের। ২০০০ সালের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন অনুযায়ী, ঢাকার নদী, খাল ও জলাভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবোর। অন্যদিকে ঢাকার সব খালের মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন। এই অবস্থায় নর্দমা-খালও পরিষ্কার থাকছে না, খাল-জলাভূমিকে দখলমুক্তও রাখা যাচ্ছে না। যেকোনো সমস্যার জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করেই খালাস! ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করবে কে? দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পাউবো, জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়-জলাবদ্ধতা নিয়ে সবারই যখন নানা দায়িত্ব ও রশি টানাটানি, তখন কাজটি করার আসলে কেউ নেই। এভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক কাজই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনা।