টাকা-পয়সা বাজি ধরিয়া যে কোনো খেলাতে হার-জিতসহ অংশ গ্রহণ করাকে সাধারণত ‘জুয়া খেলা’ বলা হইয়া থাকে। অর্থাৎ যে কোনো খেলার মাধ্যমে বাজি ধরিয়া অস্বাভাবিক টাকা-পয়সা হস্তগত করার নামই জুয়া খেলা। যিনি জুয়া খেলিয়া থাকে, তাহাকে জুয়াড়ি বলা হইয়া থাকে। তাফ্সীর মা’আরেফুল কোরআনে আল-কোরআন এর সূরা আল-বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয় হইতে জানা যায় যে, জুয়া খেলা সম্পর্কে কোরআন মাজীদ শরাব বা মদ বিষয়ে প্রদত্ত আদেশেরই অনুরূপ বিধান প্রদান করিয়াছেন। ইহাতে বলা হইয়াছে যে, মানুষের জন্য শরাব বা মদ পানে কিছুটা উপকারও রহিয়াছে। কিন্তু ইহাতে উপকার অপেক্ষা ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ।
অপরদিকে জুয়া খেলার লাভ সম্পর্কে প্রায় সকলেই অবগত আছেন। যদিও খেলায় জয়লাভকারী একজন দরিদ্র লোক একদিনেই ধনী হইয়া যাইতে পারে। কিন্তু জুয়া খেলার আর্থিক, সামাজিক এবং আত্মিক ক্ষতি সম্পর্কে অনেক কম লোকই অবগত। যেমন- জুয়া খেলা একজনের লাভ এবং অপরজনের ক্ষতির উপর পরিক্রমণশীল। জয়লাভকারীর কেবল লাভই লাভ, আর পরাজিত ব্যক্তির ক্ষতিই ক্ষতি। কেননা, এই খেলায় একজনের মাল অন্যজনের হাতে চলিয়া যায়। এতে একদিকে যেমন পরাজিত ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়া যায়। অন্যদিরেক পরাজিত ব্যক্তির পরিবারসহ সমাজের আর্থসামাজিক মর্যাদার ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হইয়া থাকে। এই জন্য জুয়া খেলা সামগ্রিকভাবে জাতিকে ধ্বংস করিয়া থাকে এবং মানব চরিত্রের অধঃপতন ঘটায়।
যেই ব্যক্তি ইহাতে লাভবান হয়, সেই ব্যক্তি পরোপকারের ব্রত হইতে দূরে সরিয়া রক্ত পিপাসুতে পরিণত হইয়া পড়ে। পক্ষান্তরে জুয়া খেলায় পরাজিত ব্যক্তির নিকট অনুভূতি হইয়া থাকে যে, যেনো তাহার মৃত্যু আগাইয়া আসিয়াছে, অর্থাৎ নিজের নিকট বিতৃষ্ণা মনে হইয়া থাকে। অথচ যিনি জয়লাভকারী তিনি আয়েশ বোধ করিতে থাকে এবং নিজের পূর্ণ সামর্থ এতে ব্যয় করিয়া খুশিতে মহামশগুÍল। ইসলামের দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য জুয়া খেলার বিপরীত। কেননা, জুয়া খেলায় উভয় পক্ষের লোকসান হইয়া থাকে। কারণ- যে ব্যক্তি খেলায় জয়লাভ করিয়া থাকে, সেই ব্যক্তি ক্রমেই লোভের বশঃবর্তি হইয়া বিপথে চলিতে থাকে। এতে বিজয়ী ব্যক্তির লাভ সাময়িক দৃশ্যমান হইলেও লাভের চেয়ে সামগ্রিক ক্ষতিই আধিক্য। অন্যদিকে ব্যবসা দ্বারা ক্রয়-বিক্রয়কারী’র অর্থকড়ি হস্তান্তরে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং উভয় পক্ষই ইহাতে লাভবান হইয়া থাকেন।
জুয়া খেলার একটি বড় ক্ষতির দিক হচ্ছে এই যে, জুয়াড়ি প্রকৃত উপার্জন থেকে বঞ্চিত হইয়া থাকে। কেননা, তাহার কেবলমাত্র চিন্তা থাকে যে, বসিয়া বসিয়া একটি বাজির মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যেই অন্যের অর্থকড়ি হস্তগত করিবে, যাহাতে কোনো পরিশ্রমের প্রয়োজনই নাই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, ইহাতে অতি সহজে অন্যের মাল-সম্পদ হস্তগত হয়। জুয়া খেলা যদি দু’চার জনের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তাহাতেও আলোচ্য ক্ষতি পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। কিন্তু বর্তমান যুগকে অনবিজ্ঞ দূরদর্শিতাবিহীন অনেকেই উন্নতির যুগ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন। যদিও চারিদিকে আজকাল সভ্যতার নাম ভাঙ্গিয়া বেহাইয়াপনা দৃশ্যমান। একদিকে নতুন নতুন রকমারি শরাব বা মদ আবিষ্কার করিয়া নিত্য নতুন নাম দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে স্বাদেরও নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়া নানাবিধ পদ্ধতিতে তাহার প্রচলন ঘটানো হইতেছে। অনুরূপভাবে জুয়া খেলার বিভিন্ন প্রকার পন্থা বাহির করা হইতেছে। এর মধ্যে বহু দিক রহিয়াছে যাহা সামগ্রিক।
এই সকল নতুন পদ্ধতিতে সম্মিলিতভাবে গোটা জাতির নিকট হইতে কিছু কিছু করিয়া টাকা নেওয়া হয় এবং ক্ষতিটা সকলের মধ্যে বন্টন করা হইয়া থাকে। ফলে তাহা দেখার মতো কিছু হয় না। আর যে ব্যক্তি এই সকল অর্থ পায়, তাহা সকলের দৃষ্টিতে ধরা পড়িয়া যায়। ফলে অনেকেই তাহার ব্যক্তিগত লাভ লক্ষ্য করিয়া জাতির সমষ্টিগত ক্ষতির প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। এই জন্য অনেকেই এই সকল নতুন প্রকারের জুয়া জায়েয জায়েয বলে মনে করিয়া থাকে। অথচ এতেও সেই সকল ক্ষতি নিহিত, যাহা সীমিত জুয়ায় বিদ্যমান। একদিকে জুয়ার এই নতুন পদ্ধতি প্রাচীন পদ্ধতি জুয়া অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর এবং প্রতিক্রিয়া সুদূর প্রসারী ও সমগ্র জাতির পতনের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ফলে জাতির সাধারণ মানুষের সম্পদ দিন দিন কমতে থাকে; আর কয়েকজন পুঁজিপতির মাল বাড়তে থাকে। ইহাতে সমগ্র জাতির সম্পদ কয়েক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীয়ভূত হওয়ার পথ খুলিয়া যায়। পক্ষান্তরে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিধান হচ্ছে এই যে, যেই সকল ব্যবস্থায় সমগ্র জাতির সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েক ব্যক্তির হাতে জমা হওয়ার পথ খুলিয় যায়, তাহার সবগুলো পন্থাই হারাম। যাহার জলজ্যান্ত প্রমাণ রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জুয়া খেলার ‘ক্যাসিনো’ মালিকদের বাসা-বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্যের অফিস মিনি ব্যাংকে পরিণত। এইসব স্থান হইতে অস্বাভাবিক নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আল-কোরআনে সম্পদ বণ্টন করিবার যেই নিয়ম-নীতি শরীয়ত নির্ধারণ করিয়াছে, তাহার উদ্দোশ্য হচ্ছে, ধন-দৌলত যেনো কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে পুঞ্জীভূত না হইয়া পড়িয়া যায়। তাহা ছাড়া জুয়া খেলার আরও একটা ক্ষতির দিক হচ্ছে এই যে, জুয়াও শরাব কিংবা মদ পান করার মতো পারস্পারিক ঝগড়া-বিবাদ ও ফেৎনা-ফাসাদের সৃষ্টি করিয়া থাকে। জুয়া খেলায় পরাজিত ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই জয়ী ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা পোষণ করিয়া থাকে এবং শত্রু হইয়া দাঁড়ায়। সুতরাং জুয়া খেলা, সমাজ ও সভ্যতার জন্য অত্যন্ত ভয়াভহের বিষয়ও বটে। কোরআন শরীফে বিশেষভাবে এই সকল ক্ষতির কথা উল্লেখ রহিয়াছে। সূরা আল-মায়েদার এক আয়াতে উল্লেখ রহিয়াছে যে, শয়তান শরাব ও জুয়া দ্বারা তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির এবং নামাজ হইতে বিরত রাখিতে চায়।
ফিকাহ্ শাস্ত্রের কয়েকটি নিয়ম হইতে জানা যায় যে, আলোচিত আয়াতে শরাব বা মদ ও জুয়ার কিছু আদৌ উপকারের কথা স্বীকার করেও তাহা হইতে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে। যাহার ফলে বোঝা গেলো যে, কোনো বস্তু কিংবা কোনো কাজে দুনিয়ার সাময়িক উপকার বা লাভ থাকিলেই শরীয়ত এই সকল হারাম করিতে পারে না, এমন কথা নাই। কেননা, যেই সকল খাদ্য বা ঔষধ উপকারের চাইতে ক্ষতি বেশী, তাহাকে কোনো অবস্থাতেই প্রকৃত উপকারী বলিয়া স্বীকার করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, সাপের বিষ জীবন রক্ষাকারী এ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ তৈরির উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হইলেও সরাসরি সাপের বিষ গ্রহণ করা বোকামি বৈ অন্যকিছু নয়। কেননা, পরিশোধিতহীন বিষ জীবননাশের কারণ।
অপরদিকে, পৃথিবীর সব চাইতে নিকৃষ্ট খারাব বস্তুতেও কিছু না কিছু উপকার নিহিত থাকা মোটেও বিচিত্র নয়। প্রাণসংহারক বিষ, সাপ-বিচ্ছু কিংবা হিংস্র জন্তুর মধ্যেও কিছু না কিছু উপকারিতার দিক অবশ্যই খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে যেসকল বস্তুতে উপকারের তুলনায় ক্ষতি বেশী, শরীয়ত সেইগুলোকেও হারাম সাব্যস্ত করিয়াছে। চুরি-ডাকাতি, যেনা-প্রতারণা এমন কি রহিয়াছে যে, যাহাতে উপকার কিছুই নাই? কেননা, কিছু না কিছু উপকার না থাকিলে কোনো বুদ্ধিমান মানুষ এইসবের ধারের কাছেও যাইতো না, এটাই স্বাভিক। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই সকল কর্মে তাহারাই বেশী লিপ্ত, যাহারা অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ বলিয়া সমাজে বিবেচিত। যাহার প্রমাণ, ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বাধীন ক্লাবগুলোতে ‘ক্যাসিনো ও মাদক দ্রব্য’ এর সমাহার। ইহাতেই বুঝা যায় যে, প্রতিটি অন্যায় কাজেও কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই রহিয়াছে। যেইহেতু এই সকল উপকারের চাইতে ক্ষতি ভয়াভহ, এইজন্য কোনো সু-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক এইগুলোকে স্বভাবতই উপকারী বা হালাল বলিবেন না। ইসলামী শরীয়ত শরাব কিংবা মদ এবং জুয়াকে এই ভিত্তিতেই হারাম বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে।
ফিকাহ্ শাস্ত্রের অপর একটি মাসআলা হইতে জানা যায়, আলোচ্য আয়াতের দ্বারা এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, উপকার হাসিল করিবার চাইতে সর্বদাই ক্ষতি রোধ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বিধেয়। অর্থাৎ কোনো একটি কাজে কিছু উপকারও হইবে, আবার ক্ষতিও হইবে, এইক্ষেত্রে ক্ষতি হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য লাভ ত্যাগ করিতে হইবে। লাভের পাশাপাশি ক্ষতিও হইবে ওইসকল উপকার সর্বাস্থায় পরিত্যাজ্য। জুয়া খেলা বিভিন্নভাবে সংঘঠিত হইয়া থাকে। জুয়া যে কোনো প্রকারেই হোক না কেনো, তাহা সর্বদায় বর্জনীয়। এই ব্যাপারে সহীহ্ হাদীসে দাবা-পাঞ্জা জাতীয় খেলাকেও হারাম বলা হইয়াছে। কেননা, এই সকল খেলাতেও বহু ক্ষেত্রেই টাকা-পয়সার বাজি ধরা হইয়া থাকে। তাহা ছাড়াও আজ-কাল এই সকল খেলাগুলো পোশাদাড় জুয়াড়িদের সর্বাদিক প্রিয় খেলা হিসাবে পরিচিত।
অপরদিকে, মুসলীম শরীফে বারীদা (রা.) এর উদ্ধৃতিতে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি ছক্কা-পাঞ্জা খেলে সে যেনো শুকুরের গোস্ত ও রক্তে স্বীয় হস্ত রঞ্জিত করে। হযরত আলী (রা.) বলিয়াছেন, ছক্কা-পাঞ্জাও জুয়ার অর্ন্তভূক্ত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলিয়াছেন যে, দাবা, ছক্কা-পাঞ্জা খেলা অপেক্ষাও মন্দনীয়। (ইবনে- কাসীর)
পরিশেষে বলা যায়, যে কোনো খেলায় যদি টাকা-পয়সার হার-জিত শর্ত থাকে তবে সেটা হারাম বলেই বিবেচ্য।
(লেখক: এম.কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)