চলনবিলের পানি শুকিয়ে গেছে। নদী আর খাল-ডোবায় পানি রয়েছে। এই পানিতে অসাধু মৎস্য শিকারীরা বিষ প্রয়োগে মাছ নিধনের মহা উৎসবে মেতে উঠেছে। এদিকে মাছ নিধনের পাশাপাশি শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই চলনবিল এলাকায় পরিযায়ী পাখি শিকার চলছে অবাধে। একদা এই অঞ্চল ছিল পাখির অভয়াশ্রম। দেশের সবচেয়ে বড়বিল চলনবিল। প্রতি বছর শীত প্রধান দেশ হতে এখানে রকম রকম পাখি এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করে থাকে। যদিও এখন পাখি আসা কমে যাচ্ছে। বর্ষার পানি নামতে শুরু করলেই, মাছ আর বোনা আমন ধান খেতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে নামতো চলনবিলে। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠত বিলটি। শীতের শুরুতেই এখন সেই বিলের পাখিরা শিকারিদের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে যাচ্ছে। চলছে অবাধে পাখি নিধন। দেখার যেন কেউ নেই। বিলের মাঝ দিয়ে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক নির্মান হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার পাখি শিকার বেড়ে গেছে। কমে গেছে অতিথি পাখির আগমন। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার চলনবিল এলাকায় এখন বিষ প্রযোগে মাছ নিধনের সাথে চলছে পাখি শিকার। শৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা বন্দুক,বিষটোপ,জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এসব পাখি নিধন করছেন। এতে একদিকে বিলের জীববৈচিত্র বিনষ্ট হচ্ছে,অন্যদিকে ফসলি জমিতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ বাড়ছে। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালে বন্য প্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দ-ের বিধান রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে,পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, এক লাখ টাকা দ- বা উভয় দ-ে দ-িত। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে অপরাধীর দুই বছরের জেল, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান আইনটিতে রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের কোনো প্রয়োগ হতে দেখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বলেন,পাখিরা শুধু প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে না, ভারসাম্যও রক্ষা করে থাকে। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে এরা কৃষকের উপকার করে থাকে। কিন্তু আইন থাকলেও পাখি নিধন বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখি না। এ কারণে দেশ থেকে নানা প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হচ্ছে।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার চলনবিল অংশের স্থানীয়রা জানান, শীতের শুরুতেই বিলের পানি নেমে যায়। এ সময় অল্প পানিতে খাবার সংগ্রহের জন্য বিলে প্রচুর দেশি ও অতিথি পাখি আসে। চলতি মৌসুমে বিলে আমন ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। এবারের বন্যা একটু লম্বা হওয়ায় প্রচুর মাছ হয়। ফলে চলনবিলে ঝাঁকে ঝাঁকে বালিহাঁস, বাটুল, চখাচখি, শামখোল, পানকৌড়ি, কায়ুম ও বিভিন্ন প্রজাতির বকসহ অতিথি পাখি বিলে নামতে শুরু করেছে। আর এ সুযোগে একশ্রেণির শৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারি বন্দুক,বিষটোপ, কারেন্ট জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে প্রতিনিয়ত পাখি নিধন করছেন। আর প্রকাশ্যে এসব পাখি বিক্রি হচ্ছে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা-উপজেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায়। চলনবিলের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বর্ষার পানি অনেকটাই নেমে গেছে। বিস্তীর্ণ বিল বিল জুড়ে দ্বীপের মতো অনেক এলাকা তৈরি হয়েছে। তার পাড়েই বোনা আমন ধান কাটা শুরু করেছে কৃষক। শত শত সাদা বক ও পানকৌড়ি চখাচখি এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু মানুষ লাঠি হাতে পাখিগুলোকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আর তাড়া খেয়ে জালে ও ফাঁদে পড়লে পাখিগুলোকে খাঁচায় আটকানো হচ্ছে। চাটমোহর উপজেলার বিলকুড়ালিয়া বিলপাড়ের পেশাদার পাখি শিকারি আমির আলী জানান,বাজারে পাখির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই কোনোমতে ধরতে পারলেই বিক্রি করতে সমস্যা হয় না। প্রতি জোড়া সাদা বক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, চখাচখি ১০০ থেকে ১২০, কাইয়ুম পাখি ৩৫০ থেকে ৪০০ ও বালিহাঁস ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। ফলে বেশি লাভের আশায় অনেকেই মাছ ধরা বাদ দিয়ে পাখি শিকারে নেমেছে এখন। নাটোরের বড়াইগ্রামের জোনাইল এলাকার পাখি শিকারি গোলাপ হোসেন জানান, চলনবিল এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাখি নামে চাটমোহরের বিলকুড়ালিয়া, খলিশগাড়ী, চিরইল, জিয়েলগাড়ী, ডিকশি বিল, শাপলার বিল ও ঝাঁকড়ার বিলে। ফলে এই বিলগুলোতে শিকারিদের আনাগোনাও বেশি। বিল অঞ্চলে প্রশাসনের কোনো লোকজনও আসেন না। ফলে শিকার চলে নির্বিঘেœ।
এদিকে বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর ডোবা আর খালের পানিতে বিষ প্রযোগ করে সমস্ত মাছ তুলে নেওয়া হচ্ছে। এক শ্রেণীর অসাধু মৎস্য শিকারী এই অপকর্মের সাথে জড়িত। এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মাহবুবুর রহমান বললেন,আমরা শুনছি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট জায়গার বিষয়ে জানলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। তিনি বলেন,আমরা ডিকশি বিল,বিলকুড়ালিয়াসহ অন্যান্য এলাকার মৎস্যজীবিদের এ বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।