ঘন কুয়াশা ও তীব্র শৈত্য প্রবাহের কারণে লালমনিরহাটের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পৌষ মাসের শুরুতে কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট জেলার জনজীবন একেবারে কাহেল। শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগ। আর এসব রোগের মধ্যে ডায়রিয়া আক্রান্তের শিশুর সংখ্যাই বেশি। গত কয়েক দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ১৫-২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই শিশু। এদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগী রয়েছে বলে জানিয়েছেন জরুরী বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ প্লাবনী রায়।
গত কয়েক দিনের তীব্র শীতে লালমনিরহাট তিস্তা ও ধরলা নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারন করেছে। বিশেষ করে তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীর চরসহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের অবস্থা চরম শোচনীয়। খড়কুটো জ¦ালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকে। সবচেয়ে বেশী প্রভাব পড়েছে বৃদ্ধ ও শিশুদের মধ্যে। বিশেষ করে রেল স্টেশনসহ জেলার বিভিন্নস্থানে অবস্থানকারী ছিন্নমুল মানুষগুলো শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। শীতার্ত মানুষগুলো এক টুকরো গরম কাপড়ের জন্য তাকিয়ে আছে সরকার ও বিত্তবান লোকদের দিকে। ঘন কুয়াশার পাশাপাশি তীব্র শৈত্য প্রবাহের কারণে জেলায় গত তিন দিনে জেলার কোথাও সূর্যের দেখা মিলে নাই।
জেলার ৫টি উপজেলার নদী অধ্যুষিত ইউনিয়নের তিস্তা নদীর চর অঞ্চল গুলোতে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ সরকারী শীতবস্ত্ররের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে। তাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ জরুরী হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি শৈত্য প্রবাহের কারণে শিশুদের মধ্যে শীত জনিত রোগ দেখা দিয়েছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট এলাকার শহিদার রহমান রমিচা বেগম দম্পত্তির ৭ মাস বয়সী মেয়ে সারমিন সুমাইয়া গত ১০ দিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছে। স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকদের দেয়া পরামর্শে কয়েকদিন চেষ্টার পর বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করেছেন। কৃষক শহিদার রহমান মেয়েকে সুস্থ করতে বাইরে থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকার ওষুধ ও স্যালাইন কিনে এনেছেন। হাসপাতাল থেকে শুধুমাত্র মুখে খাওয়ার স্যালাইন দিয়েছে দাবি করে শহিদার বলেন, নামে সরকারি হাসপাতাল। সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে খাওয়াতে হয়। না ডাকা পর্যন্ত নার্স বা চিকিৎসক রোগী দেখেন না বা খোঁজ-খবরও নেন না এখানে।
শহরের শহীদ শাহজাহান কলোনি (ডাল পট্টি) এলাকার শমশের আলীর এক বছর বয়সী মেয়ে সোনিয়াকে সকাল ১১টায় ডায়রিয়ার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জরুরি বিভাগের লেখা নির্দেশনাপত্র মোতাবেক সাড়ে তিনশ’ টাকার ইনজেকশন ও ওষুধ কিনে এনেছেন শিশুটির পরিবার। কিন্তু ভেইন খুঁজে না পাওয়ায় দেয়া হয়নি সেই ইনজেকশন। তাকে শুধু খাবার স্যালাইন দেয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে।
লালমনিরহাটে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) রাত থেকে শীতের দাপটে বিপর্যস্ত জীবন যাত্রার মান। এ জেলার ৪৫টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার কয়েক হাজার শীতাত অসহায় গরিব মানুষ পৌষের হাড় কাঁপানো কনকনে শীতের কারণে ঘর থেকে বের হতে না পারায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে। জেলার বিভিন্ন বাজার গুলোতেও সন্ধ্যার পর পরেই দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোকজনের চলাচলও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম।
হাট-বাজারের পুরাতন কাপড়ের দোকান গুলোতে নি¤œ আয়ের লোকজনের ভীর দেখা যাচ্ছে। তবে এ সকল শীত বস্ত্রের দাম বেশি হওয়ায় অভাবী লোকগুলো কিনতে পারছে না তাদের প্রয়োজনীয় সেসব শীতবস্ত্র। তীব্র শীতের কারণে জেলায় শীতবস্ত্র বিতরন জরুরী হয়ে পড়েছে। এভাবে ঘন কুয়াশা ও তীব্র শৈত্য প্রবাহ অব্যাহত থাকলে দেখা দিতে পারে ডায়রিয়াসহ শীতজনিত নানা রোগ-ব্যাধী।
পেটের টানে কিছু দিন মুজুর ঘর থেকে বের হলেও শীতের কারণে কাজ খুজে পাচ্ছেন না। শীতের পোশাক না থাকায় নিম্ন আয়ের অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। জেলায় সরকারি ভাবে কিছু কিছু এলাকায় শীতার্তদের মাঝে গরম কাপড় বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য।
সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের তিস্তা পাড়ের দিনমজুর জাহেদুল হক বলেন, ‘চরে বসবাসকারী আমরা এখানকার কয়েক হাজার মানুষ ভীষণ কষ্টে আছি। কেউ আমাদের কোন খবর নেয় না কোন প্রকার শীতবস্ত্র বা একটা কম্বলও দিচ্ছে না আমাদের। যাতে করে আমরা চরাঞ্চলের শীতার্ত মানুষ গুলো শীত নিবারন করতে পারি। আমরা কয়েক হাজার মানুষ কঠিন এই শীতে মানবেতর জীবন যাপন করছি।’ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় কাহিল হয়ে পড়ছে হিমালয়ের পাদদেশের লালমনিরহাট জেলার মানুষ। ঠা-ার দাপটে নিদারুণ কষ্টে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। চরম কষ্টে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া ও চরাঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ করা অব্যাহত রয়েছে জেলার বিভিন্ন স্থানে।
লালমনিরহাট জেলা আ.লীগের সাধারন সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাড. মতিয়ার রহমান বলেন, জেলায় অনেক শীতার্ত মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারী ভাবে এসব শীতার্ত মানুষের শীতবস্ত্র বিতরন করা হলেও তারপরেও বাকী থেকে যাচ্ছে। তাই তিনি সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তবান লোকজনকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন (সিএস) ডাঃ আবুল কাশেম বলেন, গত কয়েক দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ১৫-২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই শিশু। এদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগী বেশী।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আবু জাফর বলেন, সরকারি ভাবে যে পরিমাণ শীতবস্ত্র পাওয়া গেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত। তার পরেও আমাদের স্টোকে থাকা প্রায় ৩হাজার কম্বল শীতার্ত মানুষের মাঝে বিতরন করা হয়েছে। আমরা বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা ও সামাজিক সংগঠনের কর্ণধারদের সহযোগিতা কামনা করছি। অনেকেই এসব শতিার্ত মানুষদের জন্য শীতের কাপড় দিচ্ছেন। তবে আরও বেশি শীতের কাপড় দরকার বলে তিনি জানান।
লালমনিরহাট জেলার বেসরকারী সামাজিক সংগঠন গুলোর আয়োজনে গত কয়েকদিনে জেলার সীমান্ত এলাকায় শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরন করলেও সরকারীভাবে এখনো কোথাও তেমন কোন শীত বস্ত্র বিতরন করা হয়নি।
লালমনিরহাট জেলা ত্রান ও পুনর্বাসন সুত্রে জানাগেছে প্রাথমিক অবস্থায় শীতবস্ত্রের চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পত্র প্রেরন করা হয়েছে। এসব শীতবস্ত্র এ মাসের মধ্যেই আসবে এবং তা বিতরন করা হবে বলে জানাগেছে।