বুধবার ফুলতলী ছাহেব বাড়ি সংলগ্ন বালাই হাওরে অনুষ্ঠিত হলো উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ১২তম ইন্তেকাল বার্ষিক উপলক্ষে বিশাল ঈসালে সাওয়াব মাহফিল। এতে মুরিদীন-মুহিব্বীনের উদ্দেশ্যে তা’লীম-তরবিয়ত পেশ করেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, মুরশিদে বরহক হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, ইসলাম আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ ধর্ম। অন্যান্য ধর্মের সাথে এর তুলনা করলে আমাদের মাথা সিজদাবনত হয়ে বলতে বাধ্য হবে- আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। তিনি বলেন, সব ধর্ম ও মতবাদ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। এক্ষেত্রে মূল বই অধ্যয়ন করা জরুরি। কেননা ভুল ব্যাখ্যা পড়লে বিভ্রান্ত হতে পারেন। পাশাপাশি সীরাত অধ্যয়ন করুন। আপনার নিকট দিবালোকের ন্যায় ভেসে উঠবে পৃথিবী কেমন অন্ধকারে আচ্ছাদিত ছিল আর সিরাজাম মুনীরার আলোয় কিরূপ আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি মা-বাবার খেদমতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, যখন মা জননী ছিলেন, শিশুর মতো তাঁর কাছে বসতাম। তিনি মাথায় হাত বুলাতেন। আজ তিনি নেই। গভীর রজনীতে কে আমাকে স্মরণ করবে? আমরা যেন মা-বাবাকে স্মরণ করি, তাদের জন্য নয়নের জল ফেলি। মা-বাবা জীবিত থাকলে যেন তাদের খেদমত করি। তিনি বলেন, এতীম-অনাথ-মজলুম মানুষের আসরে আমাকে উপস্থিত হতে হয় তাই সাধারণত বড় মাহফিলে উপস্থিত হতে পারি না। নাফ নদীর তীরে কত মজলুম মানুষের স্মৃতি অবলোকন করেছি। সমাজের এ সকল অসহায় মানুষের জন্য আমরা যেন খেদমত অব্যাহত রাখি। আলিমদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নিজেরা পড়া-শুনা করুন, দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করুন, মানুষকে পথের দিশা দিন। হাফিযে কুরআন যাঁরা আছেন পবিত্র কুরআনকে হিফাযত করুন, যেন এ কুরআন বুকে ধারণ করে হাওযে কাওসারের পাশে উপনীত হতে পারেন। সাধারণত পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। যথাসম্ভব হিংসা-বিদ্বেষের পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন, প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হোন, পরষ্পরের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক বিস্তার করুন। তিনি শ্বাস-প্রশ্বাসের যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, শ্বাসের যিকিরের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ আল্লাহর যিকিরে প্রকম্পিত হয়। সুতরাং এর প্রতি মনোযোগী হোন।
লাখো মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ মাহফিল সকাল ১০টায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই জনতার ঢল নামতে শুরু করে। যুহরের পর কানায় কানায় পূর্ণ হয় মাঠ। খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, খতমে খাজেগান, খতমে দালাইলুল খাইরাতের পাশাপাশি স্মৃতিচারণমূলক ও জীবনঘনিষ্ট আলোচনায় অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে অতিবাহিত হয় পুরো দিন। বাংলাদেশ আন্জুমানে আল ইসলাহর সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী’র পরিচালনায় মাহফিলে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাসূলে পাক (সা.)-এর ৩৩তম ও বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর ১৯তম অধ:স্তন বংশধর বিশিষ্ট বুযুর্গ শায়খ সায়্যিদ আফীফুদ্দীন জিলানী আল বাগদাদী। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস আল্লামা হবিবুর রহমান, ভারতের উজানডিহির পীর ছাহেব হযরত মাওলানা সায়্যিদ মোস্তাক আহমদ আল মাদানী, সায়্যিদ জুনাইদ আহমদ আল মাদানী, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ হযরত আল্লামা নজমুদ্দীন চৌধুরী, দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান, মাওলানা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, মুফতী মাওলানা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কমরুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, যুক্তরাজ্যের ব্রিকলেন জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব মাওলানা নজরুল ইসলাম।
মাহফিলে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হাফিয মাওলানা ফখরুদ্দীন চৌধুরী, জালালপুর জালালিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা জ.উ.ম আবদুল মুনঈম, সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা ছালিক আহমদ, বুরাইয়া কামিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী, জকিগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মোশাহিদ আহমদ কামালী, দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিছ মাওলানা বদরুজ্জামান রিয়াদ, মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।
মাহফিলে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আলহাজ হাফিয আহমদ মজুমদার এমপি, সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ শফিকুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা এ.কে.এম মনোওর আলী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাওলানা আবদুর রকিব, বিশিষ্ট আলিমে দ্বীন মাওলানা আব্দুশ শাকুর চৌধুরী ফুলতলী, দারুল হাদীস লাতিফিয়া ইউকে’র সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা ইলিয়াছ হোসাইন, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার এণ্ড টেকনোলজি’র ভিজিটিং ফেলো আনোয়ার আলী, যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ এর ডেপুটি মেয়র দিলওয়ার আলী, ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ও সিলেট সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের প্রিন্সিপাল কবি কালাম আজাদ, আনজুমানে আল ইসলাহর সহসভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা ছরওয়ারে জাহান, সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা মঈনুল ইসলাম পারভেজ, সৎপুর কামিল মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা শফিকুর রহমান, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল কাইয়ূম সিদ্দিকী, জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দিন চৌধুরী, বিয়ানীবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব, ইকড়ছই আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ছমির উদ্দিন, মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ নূরী, পীর আখলু মিয়া, কারী আবদুর রহমান নিজামী, বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী, মুফতী শাহ আলম জিহাদী, ড. সাইফুল ইসলাম আল আযহারী, শামসেবাদ দরবারের পীর ছাহেবজাদা মাওলানা জামিলুর রহমান প্রমুখ।
অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুর রহীম, রাখালগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা হবিবুর রহমান, জকিগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নূরুল ইসলাম, সৎপুর কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবূ জাফর মুহাম্মদ নুমান, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শামসুল ইসলাম, মাথিউরা সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল আলিম, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স এর সহ-সভাপতি সৈয়দ মোজাম্মিল আলী শরীফ, স্কুল অব এক্সেলেন্স-এর প্রিন্সিপাল মাওলানা গুফরান আহমদ চৌধুরী, আনজুমানে আল ইসলাহর কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মাহমুদ হাসান চৌধুরী, অর্থ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ মাওলানা আবূ ছালেহ মুহাম্মদ কুতবুল আলম, মাওলানা ফজলুর রহমান চৌধুরী ছাহেবজাদায়ে শিঙ্গাইরকুড়ি, ফেঞ্চুগঞ্জ মোহাম্মদিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ফরিদ আহমদ, সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা ছালেহ আহমদ বেতকোণী, আনজুমানে আল ইসলাহ’র কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা নজমুল হুদা খান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাওলানা আজির উদ্দিন পাশা, পাঠাগার সম্পাদক হাফিয মাওলানা নজীর আহমদ হেলাল, সমাজকল্যাণ সম্পাদক মাওলানা বেলাল আহমদ, তালামীযে ইসলামিয়ার কেন্দ্রীয় সভাপতি আখতার হোসাইন জাহেদ, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূনুর রহমান লেখন, সিলেট জেলা ব্যবসায়ী ঐক্যকল্যাণ পরিষদের সভাপতি আলহাজ শেখ মখন মিয়া, বিশ্বনাথ আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নুমান আহমদ, ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমান তালুকদার, ফরিদপুর জেলা পুলিশের এএসপি নোমান আহমদ, লতিফিয়া দারুল কিরাত সমিতি, উত্তর পূর্বাঞ্চল, আসাম’র সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আনোয়ার উদ্দিন, মাওলানা কাজি আলাউদ্দিন আহমদ, বিশিষ্ট সমাজসেবী আলহাজ নেছার আহমদ, জকিগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুস সবুর, কুলাউড়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা ফজলুল হক খান শাহেদ, ঢাকা জেলা লতিফিয়া কারী সোসাইটির সভাপতি মাওলানা আবু সাদেক মুহাঃ ইকবাল খন্দকার, মাদার বাজার আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ড. সৈয়দ শহিদ আহমদ বোগদাদী, জকিগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা এখলাসুর রহমান, চান্দগ্রাম সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, ছাতক জালালিয়া আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল আহাদ, এলাহাবাদ আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবূ তাহির হোসাইন, হাউসা আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আজিজ আহমদ, হবিগঞ্জ দারুস সুন্নাত আলিয়া মাদরাসার মাওলানা ফরিদ আহমদ, তিলক চানপুর আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল জব্বার চৌধুরী, মাওলানা আবদুল আলিম, মাওলানা আজিজুর রহমান ধনপুরী, মাওলানা সৈয়দ ইউনুছ আলী প্রমুখ।
মাহফিলে ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের জাতীয় হিফযুল কুরআন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। দুপুরের আগেই বালাইর হাওরের নির্ধারিত বিশাল প্যান্ডেল মুসল্লীতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্থ শত শত গাড়ি বহর ভোর থেকে ফুলতলী ছাহেববাড়ী অভিমুখে রওয়ানা করেন মুসল্লীরা। আট্রগ্রাম থেকে শেওল্ াপর্যন্ত সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। চার শতাধিক পুলিশের পাশাপাশি সহ¯্রাধিক স্বেচ্চাসেবক আইন শৃ্খংলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেন। গোটা ফুলতলী এলাকা মুসল্লীদের পদচারণা য়মুখরিত হয়ে উঠে মাহফিল উপলক্ষে। মাহফিল স্থলের বাইরে মুসল্লীর মূল আকর্ষণ ছিল আল্লামা ফুলতলীর মাজার । প্রিয় মুর্শিদের প্রিয় প্রাঙ্গণ স্পর্শ করে জিয়ারত করে নিজেদের ধন্য মনে করেন তারা। ভক্ত মুরিদদের শোক সায়রে ভাসিয়ে শত শত মসজিদ মাদরাসা এতিমখানা খানখাসহ নানা ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা ফুলতলী ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। অব্যাগত মুসল্লীদের খানার জন্য বিশাল আয়োজন করা হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে। ইহকালীন শান্তি, সমৃদ্ধি ও পরকালীন মুক্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয় অনুষ্ঠানে।