রংপুরের পীরগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত দেশ বরেণ্য পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ৭৮ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে।
গতকাল রোববার প্রয়াত বিজ্ঞানীর গ্রামের বাড়ি লালদীঘির ফতেহপুরে মরহুমের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কবর জিয়ারত, মোনাজাত, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণসহ নানা কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। বাদ জোহর ফতেহপুরের জয়সদনে দোয়া, মিলাদ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পীরগঞ্জের ড. এম এ ওয়াজেদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বিজ্ঞাণীর বড় ভাতিজা ছায়াদত হোসেন বকুল সভাপতিত্ব করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র তাজিমুল ইসলাম শামিমের সঞ্চালনায় অধ্যাপক নুরুল আমিন রাজা, চতরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনামুল হক শাহিন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রনি বক্তৃতা করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে ছায়াদত হোসেন বকুল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ, জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু মারুফ হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা টিএমএ মমিন, কর্মকর্তা ইনচার্জ সরেস চন্দ্র, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সকল সহযোগি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ রির্সাস এ- ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, রংপুরের ড.এমএ ওয়াজেদ স্মৃতি সংসদ, পীরগঞ্জের ড. এমএ ওয়াজেদ ফাউন্ডেশন, ড. এমএ ওয়াজেদ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় রিসোর্স এ- ট্রেনিং সেন্টার, সরকারি কারমাইকেল কলেজ,খালাশপীর বঙ্গবন্ধু কলেজ, সরকারি শাহ আবদুর রউফ কলেজ, নবগঠিত পীরগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর,রংপুর জেলা ছাত্রলীগ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মহাজোটের শরীক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন মরহুমের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে ফতেহ পাঠ ও মোনাজাত করেন। এদিকে পৃথকভাবে বাদ জোহর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী ওই বিজ্ঞানী ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী লালদিঘীর ফতেহপুরে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ২০০৯ সালের ৯ মে ইন্তেকাল করেন। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তাঁর মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ওয়াজেদ মিয়া তাঁর কর্মের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বেঁচে থাকবেন। পিতা মরহুম আবদুল কাদের মিয়া ও মাতা মরহুমা ময়জুনেসার ৪ পুত্র ও ৩ কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। গ্রামের প্রাইমারি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী ও পীরগঞ্জ থানার হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৫২ সালে রংপুর শহরের সরকারি জেলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে এই স্কুল থেকে ডিস্টিংশনসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬১-’৬২ শিক্ষা বছরের জন্য হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তারবরণ করেন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষা বছরে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘ডিপ্লোমা অব ইম্পেরিয়াল কলেজ কোর্স’ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের ‘ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে পদস্থ করা হয়।
তিনি ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-৭৩ ও ১৯৮৩ সাল গুলোয় ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ৬ মাস ধরে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরবয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফ্রেরুয়ারী পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অনেক জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেন। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। বহুল রাজনৈতিক ঘটনা সংবলিত এই দুটি গ্রন্থ সুধী পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের জন্য তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পরপর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়াও তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য। ১৯৮৯ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়া তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দুটি দুবছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া তিনি ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিনটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য। তিনি ঢাকার রংপুর জেলা সমিতির আজীবন সদস্য এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দুবছর মেয়াদকালের জন্য এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ জার্নালিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এবং ঢাকার বৃহত্তম রংপুর কল্যাণ সমিতি, উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতি, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম, বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার মির্জাপুর বছির উদ্দিন মহাবিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা। মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামে তাঁর বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।