১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চ মাসের ৬ তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইট ভেঙ্গে কমপক্ষে ৩৫০ জন কারাবন্দী পলায়ন করলে কারাবন্দী ছাত্র-যুবকের সঙ্গে কারারক্ষীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৭ জন নিহতসহ ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে একজন পুলিশ সার্জেন্টসহ আহত হন ৭ কারারক্ষী। আর ধরা পড়েছিলো মাত্র ১৬ জন। কারাগারের ফটক ভেঙে ৩৫০ জন কারাবন্দী বের হয়ে এসে স্বাধীনতার অসহযোগ সংগ্রামে যোগ দেন। কারাবন্দিদের বেরিয়ে আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা দেখা দেয় চারদিকে।
একাত্তরের ওইদিন স্বৈরাচার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে স্বাধীনতার দাবির লক্ষ্যে বাঙালিরা একআত্মা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এদিন দেশব্যাপী সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হয়। অপরদিকে, পাকিস্তানি স্বৈারাচার জেনারেল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের স্বাধীনতার আদায়ের দাবিকে ধাবিয়ে রাখার গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
৬ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণে ‘হুমকি ও ধমক’ পূর্ণ ছিল। তিনি বীর বাঙালিকে উদ্দেশে করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দিয়ে বাঙালিকে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়ে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর হিসেবে নিযুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়। ভাষণে তিনি আন্দোলনকারীদের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যতক্ষণ তিনি প্রেসিডেন্ট, ততক্ষণ কেউ পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ অখ-তার বিরুদ্ধে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে পারবে না। কোনো অরাজকতা তিনি বরদাশত করবেন না।’
ইয়াহিয়া খানের এ ঘোষণার বিরুদ্ধে পুরো বাঙালি জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ওই ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনতারা আন্দোলনে নেমে পড়েন। রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শহরে শত শত ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-জনতা দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অন্যদিকে পাকিস্তানিরাও পাল্টা সংঘর্ষ-হামলা চালাতে রাস্তায় নামে। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের আতংক ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। বাঙালিদের মাঝে বিরাজ করে চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। স্বাধীনতার আশা বুকে নিয়ে সামনের দিকে আন্দোলন চালাতে থাকে স্বাধীনতামূখি জনতা। শুধু তাই নয়, এদিন স্বৈরাচার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী স্বাধীনতার আন্দোলনকে রুদ্ধ করার নানাবিধ পায়তারায় মেতে ওঠে। স্বাধীনতার আন্দোলন করার অপরাধে স্বৈরাচারেরা বাঙালিদের ওপর চালায় অসহনীয় নির্যাতন-হামলা।
বাঙালি তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে যেমন উদ্দীপ্ত, তেমনি ফুঁসছিল বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ও ঘৃণায়। পরদিন ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন বাঙালির মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণে তিনি কী বলবেন? বহুল আকাঙ্খিত স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর বর্জ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হবে কি? এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত ছিল না সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির মধ্যে। একাত্তরের পহেলা মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ৭ মার্চ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের একদিন আগে ইয়াহিয়া খানের হুমকি-ধমকি স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তোলে। এমনিতেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন চলে। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর তা নতুন মাত্রা পায়। ঘর থেকে রাজপথে নেমে আসে বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী বাঙালি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অধীর অপেক্ষা; দৃষ্টি রেসকোর্সের ময়দানে আয়োজিত জনসভার দিকে।
সারা দেশে অর্ধবেলা হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ১ মার্চ থেকে টানা পঞ্চম দিনের মতো গোটা দেশ অচল হয়ে পড়ে। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের প্রশাসন, রাজনীতি ও আন্দোলনরত বাঙালি চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশ ও পরামর্শে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় ইয়াহিয়া সরকার। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ও পাকিস্তান টিভির ঢাকা কেন্দ্রের সব বাঙালি শিল্পী, ঘোষক-ঘোষিকা, কলাকুশলী সব অনুষ্ঠান বর্জন শুরু করেন। কেন্দ্রীয় কারাগারেও প্রচ- বিক্ষোভ দেখা দেয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্টেট ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ৬ মার্চ বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। সরকারি কর্মচারীরা এ সময় বেতন তুলে নেন এবং ব্যাংকও টাকা-পয়সা লেনদেন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ও স্বাধিকার আন্দোলনের সমর্থনে এদিন রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষাবিদ, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ও নারী-পুরুষসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ওয়ালী), পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস, পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতি, মহিলা সমিতি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলসহ অন্যান্য দল ও সংগঠনের পৃথক বিবৃতিতে গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন জানান। জাতীয় লীগ নেতা অলি আহাদ স্বাধিকার আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা করার জন্য জনসভা থেকে শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানান।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফার ব্যাপারে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। পূর্ববাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন মধ্যরাত পর্যন্ত দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সমমনা বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে ৭ মার্চের জনসভার প্রস্তুতি এবং পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে দিকনির্দেশনা দেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা ডাকসু ভিপি আসম আবদুর রব, জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার জন্য দেশের ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান জানান। তারা হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, কোনো অবস্থাতেই খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ানো চলবে না। আন্দোলন-সংগ্রাম বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গ্রেফতার, নির্যাতন, জেল-জুলুম বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে ৭ মার্চের জনসভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে। ঢাকা শহর ও এর আশপাশে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য টানটান উত্তেজনা নিয়ে সময়ের প্রহর গুনতে থাকে কোটি কোটি মানুষ।
৬ই মার্চের দিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে স্বৈরাচার পাকিস্তানিদের পূর্ব পরিকল্পিত হামলা-সংর্ঘষ। ফলে চারিদিকে সৃষ্টি হয় অরাজগতা। পাকিস্তানিদের হামলায় আহত হয়ে অকালে মারা যান নিরপরাধ অনেক স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণ। অন্যদিকে, কেউ বা আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েন। পাকিস্তানি স্বৈরাচারেরা বাঙালিদের হত্যা করে স্বাধীনতার দাবিকে ভেস্তে দিতে দেওলিয়ায় মেতে ওঠে। স্বৈরাচার পাকিস্তানিদের অত্যাচার অতিষ্ট হয়ে মুক্তিকামী জনগণ প্রতিবাদে বিক্ষোভে ছোটে পড়ে রাজপথে। এদিন পাকিস্তানিরা হামলা চালিয়ে মুক্তিকামী অগণত নারী-পুরুষকে হত্যা করে। একাত্তরের এদিনে পাকিস্তানি স্বৈরাচার শাসক গোষ্ঠী অতর্কিত হামলা চালিয়ে রচনা জঘন্যতম বর্বতা। কেঁপে তুলে বিশ্ব বিবেগ। অন্যদিকে, স্বৈরাচার পাকিস্তানিদের হামলায় থেমে থাকেননি বাঙালিরা। জীবন বাজি রেখে বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে বিন্দু মাত্রও বিৎচ্যুতি হয়নি। বরং স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালিরা শত নির্যাতনের শিকার হয়েও চালিয়ে যান তাদের সংগ্রাম। চালিয়েছেন নিজেদের আত্ম পরিচয়ের আন্দোলন। স্বৈরাচার পাকিস্তান শাসকদের ওইসব হামলাকে নিন্দা জ্ঞাপন করেন বাঙালি মুক্তিকামী জনতা।
আগের দিন বিহারী-বাঙালি শান্তি কমিটি গঠন হবার পরও ৬ই মার্চ পাকিস্তানি আর্মির সহায়তায় বিহারীরা ও পাকিস্তানি বন্ধু কিছু বাঙালি হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠন করে। লুন্ঠনের সময় স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ওই ঘটনা বিহারী-বাঙালি সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালে। রেলওয়ে কলোনী, হালিশহর, আগ্রবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালি-বিহারীর সংঘর্ষ হয়। আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গী বাজার, আসাদগ›জ, চকবাজারে সাধারণ বাঙালি ও হিন্দুদের সাথে বিহারী-জামাতে ইসলামি-ইসলামি ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।
কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠনের সাথে জড়িত বাঙালিরা জামাতে ইসলামি ও ইসলামি ছাত্রসংঘের সদস্য বলে জানান আওয়ামী লীগ নেতারা। এম, এ, মান্নান বাঙালিদের জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান করেন।
সাংবাদিকরা নির্ভিক সাহসিকতায় পরদিন ৭ই মার্চ বিভিন্ন দৈনিক পত্র-পত্রিকায় বাঙালিদের স্বাধীনতা বিরোধী স্বৈরাচার পাকিস্তানিদের অমানবিক কার্যকলাপের খবর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে। যা পড়ে বিশ্ব বিবেগ আঁতকে ওঠেছিলো।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)