১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের দিনটি ছিল রবিবার। বাংলাদেশের অঙ্কুরিত হওয়ার দিন। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ মাসের সপ্তম দিবসটিতে সূচিত হয় বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। সকাল থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম। নেতৃবৃন্দদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু। বীর বাঙালির হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে জয় বাংলা ¯ে¬াগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন।
১৯৫২সাল থেকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে মাতৃভাষার দাবিতে যে আন্দোলনের শুরু পাকিস্তান এস্টাবলিসমেন্ট (ঊংঃধনষরংযসবহঃ) দুঃশাসন ও নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে ওই আন্দোলন ক্রমেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা অজর্নের পথে এগিয়ে যায়। ৭ই মার্চ সংগ্রামী বাঙালি হয়ে ওঠে নিরস্ত্র সৈনিক। সংগ্রামমূখী বাংলা পরিণত হয় যেন বিক্ষুদ্ধ অথৈ সমুদ্র এক সীমাহীন সভা-সমাবেশ মিছিলের দেশে। স্বাধীনতাকামী জনতার সু-দৃপ্ত পদচারণায় দিকে দিকে কন্ঠে ধ্বনিত হয় তৃথার্ত বাঘের গর্জন, কিংবা সাগরের ক্ষুদ্ধ উৎতাল, সংগ্রামী শব্দ বাঁজে প্রাণে প্রাণে, জাগ্রত হয় আকাশে বাতাসে গণশক্তির হৃদয় সংগীত। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’
মার্চের ৭ তারিখের দিনটি প্রবল উত্তেজনাময় এবং আবেগঘন মুহূর্ত ছিল। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ইতিহাসের মহামানব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে জাতির উদ্দেশে প্রদান করেছিলেন তার ঐতিহাসিক বক্তব্য। ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ কোটি কণ্ঠের সঙ্গে একাকার হয়ে যে মহিমান্বিত ঐকনিনাদ বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়, তাতে জাতিগত বঞ্চনার শিকার বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যক্ত হয়েছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল সত্তরের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর। বিজয়ী দল সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য অধিবেশনে মিলিত হবে এই ছিল জাতীয় অভিলাষ। কিন্তু জনমনে কাঙ্কিত এরকম একটি গণঅভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে প্রহেলা মার্চ বেলা একটা পাঁচ মিনিটে ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারা দেশ। দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে চারদিকে। বিশেষ করে ঢাকার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শত-সহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হয় পল্টন ময়দান। বিকাল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিবাদ সভায় জনসাধারণকে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকালে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতারাই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়।
সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নীগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেওয়া স্বৈরাচারি শাসককে মেনে নেওয়ার জন্য। বাঙালিরা বিশ্বাস করে, কারও কলোনি বা করদ রাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত-কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেঙে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকিত হয়েছিল এই ¯ে¬াগানে, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, ‘বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সঙ্গে, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘স্বাধীন কর স্বাধীন কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালির কণ্ঠ একই সুরে বেঁধে দিয়েছিল। সবার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে ‘জয় বাংলা।
এক অখ- মিছিলে হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। জনস্রোতে রাজপথ পরিণত হয়। বর্তমানে যেখানে রাজধানীর সুশ্যেভিত শিশুপার্ক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, একাত্তারের ৭মার্চ মধ্যাহ্নের পর সেখানে ভরে ওঠে জনস্রোতে। চারিদিকে দেখা যায় মানুষ আর মানুষ। উদ্দেশ্য একটাই স্বাধীকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওই ময়দানে জনসভা হবে। আর সভার প্রধান আকর্ষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। তাই লাঠি হাতে প্রতিবাদী শহরের গ্রামের শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, বৃদ্ধ-যুবা সর্বস্তরের মানুষ সেখানে অপেক্ষামান। একই সঙ্গে সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ। তখন আজকের ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ এই নামটিও ছিলোনা। ছিলো ‘রেসকোর্স ময়দান’।
পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা দুইটায় সভা শুরু হওয়ার কথা। ক’দিন আগেই ঘোষণা করা হয়েছে এদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা ছিল।
সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত হয় ঢাকার আকাশ-বাতাস। বাতাসেও যেনে ঝরতে থাকে স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনের আগুন। অবশেষে বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে হাজির হয় বেলা তিনটা ১৫ মিনিটে। কিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোনো লক্ষণ দেখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। সেদিনের সেই গণমহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের স্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর-জনতা বজ্রকঠিন আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথষ্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। যেনো উপস্থিতি জনতা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তার সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ।
মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে অপেক্ষামান দশ লাখের বেশি লোকের বিশাল জনসমুদ্রে জনতার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেছিলেন- ‘আজ অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভায়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়, তারা অধিকার পেতে চায়।
নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়ী করে ছিলেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিলো জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। এবং এই শাসনতন্ত্রে ফিরেপাবে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুমূর্ষ আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারী করে আইয়ুব খান ১০বছর আমাদের গোলাম করে রাখলো। ১৯৬৬সালে ৬দফা দেয়া হলো এবং এরপর অধিকার চাওয়ার অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো।
১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো, আমরা তাঁকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু মেজরিটি পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে। তিনি মার্চের ৩তারিখ অধিবেশন ডাকলেন। আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাবো এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি ন্যায কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো, এমনকি তিনি যদি একজনও হন। জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনা হলো। ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। মওলানা মুফতি মাহমুদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারি নেতারা এলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হলো, উদ্দেশ্য ছিলো আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাঁদের আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, ৬দফা পরিবর্তনের কোনো অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ।
কিন্তু ভুট্টো সাহেব হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ডবল জিম্মী হতে পারবেন না, পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যেদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাঁদের মাথা ভেঙ্গে দেয়া হবে, হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবে না। তা সত্ত্বেও ২৫জন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য এলেন। কিন্তু পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে। বলা হলো- আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু করা হয়নি।
এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠলো। আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলো। কিন্তু কি পেলাম আমরা ? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই।
কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ যে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষকে হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার ওপর চলছে গুলি। আমরা বাংলার সংখ্যা-গরিষ্ঠ মানুষ, যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে, আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি ১০ই মার্চ তারিখে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি তাঁর সাথে টেলিফোনে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় আসুন, দেখুন, আমার গরীব জনসাধরণকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; আমার মায়ের কোল কিভাবে খালি করা হয়েছে, আমি আগেই বলে দিয়েছি, কোনো গোলটেবিল বৈঠক হবে না, কিসের গোলটেবিল বৈঠক? কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মায়ের কোল শূন্য করেছে, তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে? ২৩শে মার্চ তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহ্বান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমার দলের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে ৫ঘন্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো, কিন্তু গুলি করা হলো আমার বাংলার মানুষকে, আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের; আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের।
ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্তু আমার দাবি, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তার পর বিবেচনা করে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসবো না। এ দাবি মানার আগে পরিষদে বসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহীদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাবো না।
ভাইয়েরা আমার, ‘আমার ওপর বিশ্বাস আছে? (লাখো জনতা হাত তোলে হ্যাঁ বলে) আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি।
আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের দেনা আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের দেনা শোধ করতে প্রস্তুত।
আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।
গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে। ট্রেন চলবে, তবে সেনাবাহিনী আনা নেওয়া করা যাবে না। করলে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।
সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্টসহ সরকারি, আধা-সরকারি, এবং স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের জন্য ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে। তবে এখন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবে না। বাঙালিরা বুঝে শুনে চলবেন। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে, তবে সাংবাদিকরা বর্হিবিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।
এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। বেতন যদি না দেওয়া হয়, যদি একটি গুলি চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, যদি আমার সহকর্মীরা না থাকেন, আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।
তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। ৭কোটি মানুষকে আর ধাবাতে পারবে না।
শহীদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন। ৭দিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশ গ্রহণ করেছেন, কারফিউ’র জন্য কাজ করতে পারেননি শিল্প মালিকেরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দিবেন।
সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দেন আন্দোলন কিভাবে করতে হয় তা আমি জানি।
কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
রেডিও টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে কোনো বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবে না। শান্তি-পূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই-ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যাবে। আমার অনুরোধ প্রত্যক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।
বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ত্যাজোদ্দীপ্ত ভাষণে আরো বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম,আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রস্তুত থাকবেন, ঠান্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। কারণ, শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না। জয় বাংলা।’
এই সংগ্রাম বাঙালি জাতির নিজস্ব অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। এই অধিকার একটি উন্মেষিত জাতির রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতির পরিচয়বাহী। এঅধিকার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী নদীর বিধৌত ব-দ্বীপের সাড়ে ৩শত বছরের ইতিহাস উন্মোচনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালি জাতির শেকড় খোঁজার অধিকার।
বঙ্গবন্ধু জলদগম্ভীর কন্ঠে আরো ঘোষণা করেন- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে ঘরে ঘরে দূর্গ তোলো । রক্ত যখন দিয়েছি, প্রয়োজন হলে রক্ত আরো দেবো, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন্নাশাল্লাহ্।’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশের মতো মিছিলে মিছিলে চট্টগ্রামের পুরো শহরের সব রাস্তা লোকারন্য হয়ে যায়। জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রক¤িপত হতে থাকে চারপাশ। চট্টগ্রামবাসী বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ডা. মাহফুজুর রহমান, ডা: গোফরানুল হক, জাকারিয়া চৌধুরী, রাখাল চন্দ্র বণিক, আবদুল্লাহ-আল-হারুন, সাবের আহমেদ আজগরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ফাহিম উদ্দিন আহমেদ (তিনি পরবর্তীতে ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।)
৭ই মার্চের দিনে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন বন্দী পলায়ন করে। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে সাতজন নিহত হন। আহত হন ৩০ জন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেলা ১টা ৫ মিনিটে জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বাংলাদেশের বিুব্ধ জনতাকে দুষ্কৃতকারী আখ্যা দেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।
ইতিহাসের পরবর্তী ঘটনাবলি বিশেষ করে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার ঘটনা প্রমাণ করে তার এ ঘোষণা ছিল আসলে একটি প্রতারণা। ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলনরত পূর্ব পাকিস্তানকে দমন এবং শায়েস্তা করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল সামরিক সরকার। সে প্রস্তুতির লক্ষ্যেই সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়েছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ।
এ দিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে পাঁচ দিনব্যাপী হরতাল কর্মসূচি শেষ হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সভার প্রস্তুতি এবং জাতীয় পরিষদের নতুন তারিখ ঘোষণার বিষয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডাকসু নেতারা বৈঠকের পর বৈঠক করতে থাকেন। কর্ণেল অলি আহাদের সভাপতিত্বে বিকেলে পল্টন ময়দানে জনসভা এবং মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
যে ভাষণকে বিশেষজ্ঞরা তুলনা করেন আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস-এর সঙ্গে। অমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল ছন্দবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ১১০৮টি শব্দ সংবলিত প্রায় ১৮ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন সর্বস্তরের জনগণ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তিসংগ্রামের রূপরেখা আর চরম আত্মত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তার কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি- গণশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠবজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিল। ইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ- নেতা আর জনতার শিরদেশে যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিল। ঐতিহাসিক সেই দুর্লভ ক্ষণটিতে আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল নেতার পদপ্রান্তে বসে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত-অবহেলিত-নিরন্ন নর-নারীর অবিসংবাদিত নেতার অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করার।
সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিশপথে ভাস্বর, যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখ-মুখ শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আত্মত্যাগের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে তথা রাজনৈতিক সংগ্রামে জয়যুক্ত হয় বাঙালি জাতি। সেই সাথে ভৌগোলিক স্বাধীনতা, একটি পতাকা ও জাতীয় সংগীত অর্জন করে। কিন্তু মুক্তিসংগ্রাম তথা অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে আমরা জয়যুক্ত হতে পারিনি। এখনো আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তাই ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন এখনো অটুট, এখনো স্থায়ী জাতির মননে-হৃদয়ে-চেতনায়।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)