তেল আর পানি যেমন কখনো মিশে না। তেমনি ‘সর্প হয়ে দংশন আর ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ পরিণতি কখনো ভালো হয় না। আফগানিস্তান থেকে ট্রাম্পের সৈন্য প্রত্যাহার করা মানে এই নয় যে, ট্রাম্প শান্তিবাদী। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময় থেকেই প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে আমেরিকা তালেবান তৈরি করে। এক পর্যায়ে সর্বাধুনিক স্ট্রিংগার ক্ষেপনাস্ত্র, যেটি কাঁধে নিয়ে উৎক্ষেপন করে বিমান ধ্বংস করা যায় সেটিও সরবরাহ করে আমেরিকা। পরে সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয় হলে আমেরিকা ভোল পাল্টে, নানা ছলচাতুরতায় তালেবানদেন বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইতিহাস তার আপন পথেই চলে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাড়াতে আমেরিকার মদতে যে তালেবানি শক্তির উত্থান ঘটেছিল, আজ সে শক্তিই বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে আমেরিকার জন্য।
বর্তমান আফগান সরকার ও তালেবান গোষ্ঠীর মধ্যে চিন্তা-চেতনা, কৃষ্টি-কালচার, দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত, সেখানে আমেরিকার কূটকৌশলে একটা সময়ঝোতায় উপনীত হওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত তার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে বিশ্বের তাবৎ বিশ্লেষকরা ভীষণভাবে সন্দিহান। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই চুক্তি সূক্ষ্ম সুতার ওপর দিয়া হাঁটার মতো। আফগানের আগামীর পথ মোটেও সহজ নয়! আমেরিকা এতোদিন তালেবানদের ‘সর্প’ হয়ে দংশন করে, এখন আবার ‘ওঝা’ হয়ে ঝাড়ার মতো কেনো এমন একটি ‘সফল পরাজয়মুখী’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করল, এটাই বিস্ময়! আমেরিকা যখন কারো ‘বন্ধু’, তার আর শত্রুর দরকার নেই। বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে মেনে নিতে যে কোনো দেশকে বারবার ভাবতে হবে। কারণ, আমেরিকা বরাবরই ‘যতক্ষণ নিজ স্বার্থে প্রয়োজন ব্যবহার করে, প্রয়োজন ফুরালে আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলা’ নীতি ধারণ করে থাকে।
আফগানরা দক্ষিণ এশিয়ার একটি যোদ্ধা জাতি। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে আফগানিস্তানের গুরুত্ব ব্যাপক। ১৮৩৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে ১৮৪২ সালে কাবুল ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। এভাবে আফগান ভূমির ওপর দিয়ে অনেক শক্তিশালী বিজেতার আনাগোনা হয়েছে। আশপাশে অনেক শক্তিশালী সাম্রাজ্য ও শাসকের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু ওই ভূমি কখনই স্থানীয়দের হাতছাড়া হয়নি। কেউই নিরঙ্কুশভাবে আফগানদের করতলগত করতে পারেনি।
মার্কিন বিমানবাহিনীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানে বিগত ১০ বছরের মধ্যে গত বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি বোমা ফেলা হয়েছে। গত বছরে দেশটিতে ৭ হাজার ৪২৩টি বোমা ফেলেছে মার্কিন বাহিনী। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, এরপরও যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি স্বাক্ষরে এত আগ্রহী কেন? এর সম্ভাব্য কারণের মধ্যে একটি হলো, আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটিকে ট্রাম্পের দল ব্যবহার করবে। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে বলবে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা ফিরিয়ে এনেছে। এছাড়া উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইরান ও সিরিয়ায় মার্কিন ব্যর্থতার ওপর কিছুটা হলেও প্রলেপ দেবে। এছাড়া ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে যাওয়া ক্রমেই আমেরিকার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। ইতিপূর্বে প্রায় ১০ বছরের যুদ্ধে ভিয়েতনামে প্রায় ৫৩ হাজার সৈন্য নিহত হওয়ার পর জনগণের প্রবল চাপে মার্কিন প্রশাসন লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রতি সৈন্যের পেছনে বছরে খরচ হয় ১০ লাখ ডলার। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের খরচ প্রায় ৯ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। এই যুদ্ধে তাদের অন্তত ২ হাজার ৩০০ সৈন্য মারা গেছে এবং ২০ হাজার সেনা আহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘদিন থেকেই পলায়নের পথ খুঁজছিল আফগানিস্তান থেকে। ভিয়েতনাম-উত্তর কোরিয়া থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। আফগানিস্তান একটি রুক্ষ অনুর্বর মরুসদৃশ পাহাড়-পর্বতসঙ্কুল দুর্গম দেশ হলেও তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খণিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এ কারণেই মূলত সময়ে সময়ে বিদেশীদের কুদৃষ্টি পড়েছে দেশটির ওপর। খোদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী এবং নিকট অতীতে সোভিয়েত দখলদাররা কখনোই সেখানে আধিপত্য তো দূরে থাক, ন্যূনতম সুবিধাও আদায় করতে পারেনি। সেখানে শক্তিশালী মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতা ও নাস্তানাবুদে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সামরিক ও নৈতিক, উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিনরা তালেবানদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। সর্বশেষ বিশ্বের সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনীকে ১৯ শতকের ব্রিটিশ বাহিনীর মতোই পরাজয় বরণ করতে হলো।
এই চুক্তির সবচেয়ে বড় ঝুঁকির জায়গা ও প্রধান খেলোয়াড় হবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল বর্তমান আফগান সরকার। চুক্তিতে অনেক কিছুই খোলাসা ও স্পষ্ট করে বলা নেই। পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের শাসনপদ্ধতি কেমন হবে, বিশেষ করে চুক্তি অনুসারে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করা হলে, তখন কাবুলের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার পরিধি কেমন হবে তা স্পষ্ট নয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির এক উক্তির মাধ্যমেই বোঝা যায়, তারা এই চুক্তি নিয়ে কতখানি আশাবাদী। চুক্তির শর্তে রয়েছে, ৫০০ তালেবান জঙ্গি, যারা আফগান সরকারের হাতে বন্দি, তাদের মুক্তি দিতে হবে। আশরাফ ঘানি বলেছেন, অপরাধীকে মুক্ত করে দিতে হবে এমন শর্ত চুক্তিতে থাকা উচিত নয়।
আফগান সরকার ও তালেবানের রাজনীতিতে আমেরিকা এখন ‘গেম চেঞ্জার’। দীর্ঘ যুদ্ধে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমেরিকার। কিন্তু আমেরিকা একা দারভার ভোগ করবে কেন? প্রবাদে রয়েছে, ‘পাপি মরে দশ ঘর নিয়ে।’ আফগানিস্তানে আমেরিকা নাকানি-চুবানি খেয়ে চুক্তি অনুযায়ী সৈন্যবাহিনী উঠিয়ে নিলেও আফগান সরকারের ওপর তার যে প্রভাব রয়েছে, তলে তলে তা অব্যাহত রাখলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট চলতেই থাকবে। ট্রাম্প প্রশাসনের যদি কূটচাল থাকে, শান্তি চুক্তির আড়ালে ‘সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে’ নীতি, তাহলে আফগানিস্তানের শান্তির আশা সুদূর পরাহত। যাই হোক, তালেবানদের সঙ্গে এখন আলোচনা চলবে আফগান সরকারের। আর এর সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপরই মূলত নির্ভর করছে দেশটির ভবিষ্যত।
কাতারের রাজধানী দোহায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হলেও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইরানসহ আফগানিস্তানে যেসব রাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে তাদের ভূমিকা কী হবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তাই আদৌ এই চুক্তি সফলতার মুখ দেখবে কিÑনা, তা নিয়েও প্রবল সন্দেহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান চুক্তি আশাব্যঞ্জক মনে করা হলেও, কূটনৈতিক পর্যায়ে জটিল ও কঠিন কাজ বাকী রয়েছে।
আফগান যুদ্ধে সরাসরি তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো লিপ্ত থাকলেও অন্যান্য দেশ পরোক্ষভাবে জড়িত। বড় শক্তি হিসেবে রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের স্বার্থে কারা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকবে তা নির্ভরশীল। চীন, রাশিয়ার আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ও বাণিজ্যিক কারণে আফগানিস্তানের বিষয়ে আগ্রহী হলেও পাকিস্তানের সাথে সঙ্ঘাতময় সম্পর্ক এবং কাশ্মির সঙ্কটে আফগানিস্তানের ভূরাজনীতিতে ভারতের বড় রকমের স্বার্থ রয়েছে। বর্তমান চুক্তি যেমন তালেবানকে লাভবান করবে; তেমনি পাকিস্তানকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করবে বিধায় চুক্তি সম্পাদনে ইসলামাবাদের ওপর ক্ষুব্ধ নয়াদিল্লি। ইতিপূর্বে আফগানিস্তানে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। আদর্শ বা মানবিক জায়গা থেকে ভারত আফগানিস্তানকে সহায়তা করেনি; বরং কাবুলে ইসলামাবাদের প্রভাব হ্রাসে নয়াদিল্লি সহায়তা করেছে।
পাকিস্তান চাইবে তার প্রভাববলয় সংহত করার বাসনায় তাদের মদদপুষ্ট তালেবান সরকার কাবুলে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ভারত চাইবে পাকিস্তানি প্রভাবমুক্ত আফগানিস্তান। আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রিত কট্টর ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা হোক, এটা ভারত, ইরানেরও কাম্য নয়। কারণ আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইরান-আফগান সীমান্তে শিয়া অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে তালেবানবিরোধী ইরান সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠন সক্রিয়। একইভাবে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে যেখানে তাজিক, হাজারা ও উজবেক জনগণের বসবাস রয়েছে, তারা পশতুন জনগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তালেবান বাহিনীকে সহজে গ্রহণ করবে না। তাই দীর্ঘমেয়াদি অশান্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পরে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কী হবে, তার ওপরে নির্ভর করছে সুড়ঙ্গের শেষে আলো কতটুকু। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সখ্য সর্বজনবিদিত। অন্যপক্ষে ভারতের যে প্রভাব এখন আফগান সরকারের ওপর রয়েছে, তা হ্রাস পাওয়ার যেকোনো সম্ভাবনাকে ভারত কীভাবে মোকাবিলা করবে? এসবের উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে তালেবানের একাংশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করছে, তখন তালেবানের অপরাংশ আইএস ও আল কায়দার আনুগত্য স্বীকার করেছে। তারা সপ্তাহ না পেরোতেই আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্রবিরতির যে কথা বলা হয়েছিল, তা কার্যকর হতে এখনও অনেক পথ বাকি।
আফগানিস্তানের নাগরিকেরা চার দশক ধরে যুদ্ধের ভিকটিম হয়ে প্রাণঘাতী সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। এই চুক্তি কি তার অবসানের পথ সুগম করবে? যুদ্ধের অবসান সহজে হবে কি না তা অনেক প্রশ্নোত্তরের ওপর নির্ভর করছে। যদি কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম দৃশ্যমান না হয়, সে ক্ষেত্রে চুক্তি অর্থহীন হয়ে যেতে মোটেই সময় লাগবে না। যুক্তরাষ্ট্র আগামী ১৩৫ দিনের মধ্যে তার সৈন্যসংখ্যা ১৩ হাজার থেকে ৮ হাজার ৬০০-তে নামিয়ে আনবে এবং ১৪ মাসের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এই প্রত্যাহারের অঙ্গীকার শর্তমুক্ত নয়; চুক্তির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে আগামী দিনগুলোতে তালেবানের কার্যক্রম, আফগানিস্তানে সহিংসতার মাত্রা হ্রাস এবং তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে সফল আলোচনার ওপরে।
এতো প্রাণ, রক্ত, অর্থ, আহত, অবকাঠামো ধ্বংসের পরেও কী আফগানিস্তানে শান্তির আলো দেখা যাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয়টি নির্ভর করছে তালেবানরা যাকে নিয়মিত ‘পাপেট সরকার’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে, সেই প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারের সঙ্গে আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তার ওপর। আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে তালেবান নেতাদের ঠিক কোন ধরনের সম্পর্ক বা সমঝোতা হবে, তার কোনো রূপরেখা চুক্তিতে নেই। এ নিয়ে দ্বিমত হলে অভ্যন্তরীণ সংকট চলতেই থাকবে। আর যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তিচুক্তিও হয়ে পড়বে অর্থহীন। তাই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির সমীকরণ কোন দিকে যাবে তা সময়ই বলে দিবে।