বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক অবিষ্মরণীয় নাম মাশরাফি বিন মর্তুজা। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে মনে রাখার মতো জয়ের পর তার অবসরের ঘোষণা আসে। মাশরাফি বিন মতুর্জা একজন নেতা, সামনে থেকে দলকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া একজন কান্ডারি-যাকে বাংলাদেশ সারা জীবন মাথায় তুলেই রাখবে। তার ব্যক্তিত্ব,মানবিকতাও অতুলনীয়। একজন ভালো খেলোয়াড়ই যে ভালো অধিনায়ক হবেন তার নিশ্চয়তা নেই। তবে একজন ভালো ক্যাপ্টেন অবশ্যই একজন ভালো নেতৃত্বদানকারী মানুষ। যার অনুপ্রেরণায়,যার উৎসাহে দেশের ক্রিকেটে বহু সাফল্য এসেছে। বিদায় তো নিতেই হয় একসময়। সেই ধারাবাহিকতায় তিনিও আজ ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে মানুষ তাকে মনে রাখবে আজীবন। ক্রিকেটে মাশরাফি অধ্যায় শেষ হতে পারে, তবে শেষ হয়েও যেন তিনি মিশে থাকবেন এই ক্রিকেটেই। দেশের বহু বহু ক্রিকেটীয় উত্থানের স্বাক্ষী তিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশারাফি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি টিটুয়েন্টি থেকে অবসর নেয়ার পরেও দেশের মানুষের হৃদয় ভেঙেছিল। মাশরাফি সম্পর্কে ক্রিকেট বিশ্বের ও নিজ দেশের অতীত ও বর্তমান বড় বড় ক্রিকেট বোদ্ধারা নানারকম ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক খেলোয়াড় শন পোলোকের মন্তব্যটা এরকম-তোমরা আমাকে মাশরাফি দাও আমি তোমাদের এগারোটা সোনার ছেলে (ক্রিকেটার) দেব। যদিও এটা নিতান্তই একটা ব্যক্তিগত মন্তব্য। কিন্ত অতীতে দেশের কতজন ক্রিকেটার সম্পর্কে এমন মন্তব্য রয়েছে জানা নেই।
আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে অবস্থায় দাড়িয়ে সেখানে অবশ্য মাশরাফির একার কৃত্বিত্ব নেই। দলীয় প্রচেষ্টা ছাড়া বিজয় অর্জন করা যায় না। কিন্তু যেখানে মাশরাফির একার কৃতিত্ব রয়েছে তা হলো তার নেতৃত্ব। নেতার গুণাবলীর সবগুলোই তার চরিত্রে রয়েছে। যোগ্য নেতার মত দলকে টেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটা শুধুই মাশরাফির। এমন না যে মাশরাফি না খেললে বাংলাদেশ কোন ম্যাচে জয় লাভ করতে পারবে না। কিন্তু মাশরাফির অধিনায়কত্ব ছাড়া সেই দলটা কতটা ভাল খেলতে পারবে তা নিয়েই যত সন্দেহ। যে মানুষটা একের পর এক ইনজুরি নিয়ে পায়ে ব্যাথা সহ্য করেও দেশের জন্য মাঠে নেমেছে সে বিদায় বলাতেই মানুষের যত আবেগ। বিদায় এমনই হয়। বেদনাদায়ক এবং কষ্টদেয়ার অনুভূতি। তামিম, মুস্তাফিজ,সৌম্য,সাকিবদের নিয়ে যে আমাদের অনেক স্বপ্ন। আকবরদের নিয়েও আমাদের আজ স্বপ্ন। দিন কয়েক আগেও আকবর,তানজিল,মাহমুদুল বা শাহাদাত হোসেনের নিয়ে আমরা এতটা ভাবিনি। আমাদের দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের পাকিস্থান সিরিজে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ অনুর্ধ¦ ১৯ ক্রিকেট দল যখন একটি পাহাড় অতিক্রম করলো তখন যেনো মনে হয়েছে এবারের আসরটা আমাদের জন্য। এই অনুর্ধ¦ ১৯ বিশ^কাপটা আমরা পাবো। সেই কাজটি বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা করে দেখিয়েছে।
ইতিহাসের পাতায় আকবরের বীরত্বের কাহিনী গাঁথা হয়ে গেছে। বাধার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে রাঙাপ্রভাত যে তারাই এনেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফষ্ট্রুমে প্রতিপক্ষ ভারতকে হারিয়ে আমাদের বহুকালের অধরা স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে এই যুবকরা। এরাই তো বীর। এই খেলা থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। অন্তত কিভাবে বিরুপ পরিস্থিতিতে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তা দেখিয়েছে। হাই পারফরম্যান্সের খেলোয়াড়দের ভিড় এখন আমাদের ক্রিকেটে। ছোট দল বলে অবহেলার কাতারে ফেলতে পারবে না বাংলাদেশকে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখনও অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞই এই সাফল্যকে হঠাৎ জ্বলে ওঠা বলে ভুল করেছিল। প্রথম দিকে এ ভুলটা সবাই করে। কিন্তু এটা যে ভুল ছিল না তা আমরা ধীরে ধীরে যোগ্যতার বলে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আমরা যে একসময় ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করতে পারি তা এখন অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছে। একের পর এক সাফল্য বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ক্রমোন্নতির দক্ষতারই প্রমাণ রাখে। কয়েকবছর আােগ থেকেই বাংলাদেশ বড় বড় সাফল্য পেতে আরম্ভ করেছিল। বাকি ছিল শুধূ ধারাবাহিকতা। এবং বড় দলগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করার সক্ষমতা। এখন সেটাও পেরেছি। একটা সময় আমরা বড় দলগুলোর সাথে কোন একটা ম্যাচ জেতার জন্য সিরিহ খেলতে নেমেছি। কিন্ত আজ অবস্থা ভিন্ন। আমরা সিরিজ জেতার জন্য মাঠে নামি। এবং মাঠে নামবো হোয়াইট ওয়াশ করার জন্য। অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই বলছেন বাইরে গিয়েও জেতার অভ্যাস করতে হবে। সেটাই নাকি হবে আসল পরীক্ষা। আমরা সে পরীক্ষাতেও পাস করেছি। যেকোন পরিস্থিতিতে আমাদের ক্রিকেটারদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারলে দিনটা যে বাংলাদেশের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা আমাদের কন্ডিশনে হোক আর অন্য কন্ডিশনে হোক। আর ভারতকেও একসময় নিজেদেও মাঠে বাঘ আর অন্য দেশের মাটিতে কম শক্তিসম্পুন্ন বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট একদিন সে পর্যায়ে পৌছাবে যখন বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকবে না।
আমাদের জাতীয় দলে অনেকদিন ধরেই কয়েকজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় রয়েছে যারা যেকোন পরিস্থিতিতে খেলার হাল ধরতে সক্ষম। আমাদের রয়েছে সাকিব আল হাসানের মত বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। যাকে পেয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সত্যিকার অর্থেই ভাগ্যবান। সাকিব নিয়মিতভাবেই ভাল খেলে চলেছে। তার ধারাবাহিকতা সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সে কাউন্টি ক্রিকেট সহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আইপিএল খেলছে। এতে তার বিশ্বের উচু মানের খেলোয়াড়দের সাথে খেলার সুযোগ ঘটছে এবং তার দক্ষতা ক্রমেই বাড়ছে। যার ফল আমরা খেলার ফলাফলে পাচ্ছি। এছাড়াও উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিম এবং লিটন দাস, ড্যাশিং ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে সুনামের সাথে খেলে যাচ্ছেন। জিম্বাবুয়ের সাথে ওয়ানডে সিরিজে রান পেয়েছে তামিম ইকবাল এবং সম্ভাবনাময় ওপেনার লিটন দাস। বর্তমান ক্রিকেট দল আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের যেকোন সময়ের চেয়ে সেরা পারফরম্যান্স করা একটি দল। এই দল একটি ভারসাম্যপূর্ণ একটি দল। যেখানে নিখাদ ব্যাটসম্যান, বোলার এবং অলরাউন্ডারের সমন্বয় রয়েছে। ওপেনিং জুটি নিয়ে একটা সমস্যা ছিল বলে মনে হয়। তবে সৌম সরকার এবং তামিম ইকবাল ও লিটন দাস সে সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এরা রান পাচ্ছে এবং দলকে একটি শক্ত ভিত গড়তে সহায়তা করছে। তামিম তো অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং স্তম্ভের মধ্য অন্যতম একজন। এখন এর সাথে সৌম্য সরকার ও লিটন দাস যোগ হয়েছে। সৌম্য নিয়মিতভাবেই রান করে যাচ্ছে। এবং আমার মনে হয় আজ বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অন্যতম ভরসা হিসেবে পরিণত হয়েছে। দল হারলে আমাদের চোখেও জল আসে। আমরা ব্যথিত হই। দল জিতলে আমরা উল্লাস করি। আমাদের ভালবাসা প্রকাশ করি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে চিৎকার করি। আমরা এভাবেই আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়ে চিৎকার করতে চাই। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে চাই তাকিয়ে দেখ আমরা ক্রিকেট জগতে রাজত্ব করতে এসেছি। ওয়ানডে,টি টুয়েন্টি বা টেষ্ট যেকোন ফরম্যাটেই আমাদের লড়াই করার ক্ষমতা রয়েছে। আমরা জিততে পারি। মাশরাফি বিন মর্তুজা ক্রিকেটের একটি অধ্যায়,একটি ইতিহাস। তিনি ক্রিকেটমাঠে স্বশরীরে থাকবেনা সামনের দিনগুলিতে। আবার তিনি থাকবেনও। তিনি থাকবে প্রতিটি দর্শকদের মাঝে, তিনি থাকবেন প্রতিটি মাঠে,তিনি থাকবেন সর্বোপরি ক্রিকেটের মাঝে। এখন অবশ্য তার নতুন দায়িত্ব। তিনি এখন দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি ক্রিকেট মাঠের নেতা আবার জনগণেরও নেতা। তার অনেক দায়িত্ব। সেখানেও তিনি সফল হোন এই প্রত্যাশা করি। তাই ক্রিকেট থেকে গুডবাই ক্যাপ্টেন।
[অলোক আচার্য, শিক্ষক ও কলামিষ্ট]