‘শ্রমজীবীর ঘরে খাবার নেই শ্রমিক দিবসেও।’ এমন সংবাদ দৈনিক পত্রিকার পাতায় পড়ে খুবই ব্যথিত হয়েছি। সারাবিশ্বের মত করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে হাট-বাজার শহর-নগর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ বন্ধ থাকায়, বেকার হয়ে পড়েছে, দোকান-পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা। তার উপর আবার চলছে ছলচাতুরির রঙ্গিন খেলা। চলছে- সরকারি নির্দেশ অমান্য করায় জরিমানা আদায়ের যাচ্ছে তাই কান্ড। যেখানে গার্মেন্টস খুলে লকডাউনের বারোটা বাজিয়েছে, সেখানে আবার সরকারি নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে তিন জেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই দেশটা আর দেশ নেই জাহান্নামের টুকরো হয়ে গেছে। একদিকে করোনাকালের বেদনা, অন্যদিকে করোনাকালের বেদনাকে পূঁজি করে যাচ্ছে তাই অবস্থা চলছে সারাবিশ্বে। সেই অবস্থার মধ্যে বিসিএস ক্যাডারদের যাচ্ছে তাই অবস্থা চলছে, কেউ কেউ ত্রাণ চুরিতে ব্যস্ত, কেউ কেউ আবার সরকারকে ভাঙ্গিয়ে অন্যায়ের রাজত্ব তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারই ধারাবাহিকতায় হবিগঞ্জের লাখাইয়ে করোনা পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রন ও মনিটরিংয়ের অংশ হিসাবে স্থানীয় বুল্লা বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। ১টার লাখাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট লুসিকান্ত হাজং ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকারের নেতৃত্বে পৃথকভাবে আদালত পারিচালনা কালে সরকারি নির্দেশনার বাহিরে দোকানপাট খোলা ও বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে উপজেলার বুলস্নাবাজারে ৪টি এবং কালাউক বাজারে ৩টি মোট ৭টি প্রতিষ্টানকে ১০হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদান করা হয়। এছাড়াও রাস্থায় অনিয়ম রোধে একটি ট্রাককে ৫শত টাকা অর্থদন্ড প্রদান করেন ভ্রাম্যমান আদালত। শুধু এখানেই শেষ নয়; গণমাধ্যমের ভাষ্যনুযায়ী- মৌলভীবাজারে গোয়েন্দা পুলিশের সহযোগিতায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিভিন্ন হাট বাজার ও দোকানে মনিটরিংসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। মূল্য তালিকা না রাখা, বিএসটিআই মান পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শাহী ঘি বিক্রয় করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে রায়শ্রী সড়কের আলমাস পোল্ট্রিকে ৫ শত টাকা, চাঁদনীঘাটের রাধিকা ভেরাইটিজ স্টোরকে ৪ হাজার টাকা, নিহা ভেরাইটিজ স্টোরকে ৫ শত টাকাসহ মোট ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
একইভাবে কাহারোল উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ৮ হাজার ৫শত টাকা জরিমানা আদায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনিরুল হাসান এর নেতৃতে ও কাহারোল থানা পুলিশ এর সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার করেন। কাহারোল উপজেলার সদর কাহারোল বাজারে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করার সময় সরকারী নির্দেশনা না মেনে দোকান খুলছেন এ ধরনের ৭ জন দোকানদারকে জরিমানা করেছেন। একদিকে করোনাকালে লকডাউনে নিরন্ন থাকছে মানুষ; সেই অবস্থার ভেতরে জরিমানার মধ্য দিয়ে আরো ভয়; আরো হতাশা সৃষ্টি চলছে। যা কোনভাবেই চাই না, চাই সকল সমস্যার সমাধান হোক। কারোনাকাল কেটে যাক, কাটুক অন্ধকারের দিন। কেনণা, কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের অনন্য সংগ্রামের ইতিহাস গড়ার দিনে না খেয়ে অভূক্ত শ্রমিকরা হতাশায় ভুগছে। যদিও শুধু বাংলাদেশে নয়; বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে হতাশা বাসা বেঁধেছে ভারত আর বাংলাদেশের কোটি শ্রমিকের বুকে। লকডাউনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ও বেকার হচ্ছেন শ্রমজীবীরা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের পাঁচজন কর্মজীবীর চারজনই কোনো না-কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন করোনায়। এ অবস্থায় কঠিন দুঃসময় পার করছেন শ্রমিকরা।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলা হলেও কার্যত শ্রমিকের পেটে লাথি মারা হচ্ছে। বেতন কেটে নেয়া হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই। শ্রমিকরা যখন কর্মক্ষেত্রে তাদের অধিকার, সুরক্ষা প্রতিষ্ঠা এবং মালিক-শ্রমিক ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলবেন ঠিক সেই সময়ে তাদের ওপর নেমে এসেছে করোনার খড়গ। বেকার হয়েছেন অনেকে। তাদের সামনে আসছে আরও ভয়াবহ দুঃসংবাদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে ৬ কোটি ৩৫ লাখ কর্মক্ষম (১৫-৬৫ বছর বয়সি) মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে ২৭ লাখ ছিলেন বেকার। সেই সঙ্গে কর্মক্ষম ছদ্মবেকারের সংখ্যাও প্রায় ৬৬ লাখ। অপেক্ষাকৃত তরুণ ছদ্মবেকাররা পছন্দমতো কাজ না পাওয়ায় টিউশন, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয়কর্মী, কল সেন্টারে কর্মীসহ বিভিন্ন ধরনের খন্ডকালীন কাজ করছেন। তবে করোনার এ পরিস্থিতিতে এ শ্রেণির তরুণরাও বেশ অর্থকষ্টে আছেন। চলমান অচলাবস্থায় টিউশন ও রাইডশেয়ারিংয়ের মতো অনেক পেশা এখন বন্ধ। পরিবহণ শ্রমিকদের কথাও ভুলে যাওয়া যাবে না; যারা জাগলে জাগে দেশ, না জাগলে ঘুমায় বাংলাদেশ-বিশ্ব।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় আঘাত আসা শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী এই দুই ধরনের অর্থনীতিতেই স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। এই স্থবিরতার প্রভাব পড়ছে চাকরির বাজারে। এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া বা সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। কর্মী-শ্রমিকদের দেনা-পাওনা পরিশোধের সম্ভাব্য উপায় খুঁজছেন তারা। বহু কারখানা-অফিস ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন শিল্প ও করপোরেট-সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে যারা টিকে থাকবেন তাদের পক্ষেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা কঠিন হবে। ব্যবসা কমে যাওয়ায় আর্থিক সক্ষমতাও অনেকের কমে যাচ্ছে। আর্থিক লেনদেন কমে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক বিনিয়োগ কমবে। বিদেশি রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যে শ্লথগতির কারণে রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে অভিজ্ঞ-পুরানোদের টিকে থাকার লড়াই তীব্র হবে সেখানে নতুনদের জন্য জায়গা করে নেওয়া কঠিন হবে।
তার উপর আবার অতি মুনাফাখোররা কীভাবে কম খরচে কর্মী-শ্রমিকদের ছাঁটাই করা যায় এবং কীভাবে ব্যবসা গুটিয়ে ( লে অফ) নেওয়া যায়, সেই রাস্তা খুঁজছে। ২০০২ থেকে ১৭ সাল পর্যন্ত বিবিএসের সর্বশেষ চারটি শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ওই সময়ে ১ কোটি ৪৫ লাখ লোক কাজ পেয়েছেন। এখনো প্রায় ১ কোটি লোক বেকার বা ছদ্মবেকার। তার ওপর প্রতিবছর ২০-২২ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে শ্রমবাজারে ঢুকছেন। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও'র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেকারত্বে এশিয়ায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ১১ ভাগ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আমি যতদূর অনুমান করছি- করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই খারাপ খবর। এই দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য)। দেড় কোটির মধ্যে অধিকাংশই ইতিমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছে। গার্মেন্ট, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স ও সরকার এই চারটি খাত ছাড়া বাকি সবই ইনফরমাল (অনানুষ্ঠানিক)। করোনায় ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) কর্মজীবী ছাড়া আর সবাই এখন বেকার। বেকারের এই সংখ্যা দেড় থেকে দুই কোটি। বাস্তবতা হলো- ফরমাল কর্মজীবীদের মধ্যে গার্মেন্ট খাতের শ্রমিকরাও চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন।
খোদ রাজধানীতেই প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক এখন বেকার। ১০ লাখের বেশি রিকশাচালক কর্মহীন। গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে অঘোষিত লকডাউন শুরু হয়েছে, এর ফলে যারা হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ খাতের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, সেসব খাতে শ্রমিকরা দীর্ঘদিন বেকার বসে রয়েছেন। এমতবস্থায় সরকারের কেবল প্রণোদনা নামক কথাটিই আছে, কার্যত কোন পদক্ষেপ নেই, এই কারণে নেমে আসছে চরম দুঃসময়। আর চরম সত্য ও সুন্দর হলো এই যে, আমেরিকার বেকার হয়ে যাওয়া মানুষজন সরকার থেকে আগামী চার মাস ভাতা পাবেন। কিন্তু আমাদের দেশের বেকার হয়ে যাওয়া মানুষ কিছুই পাবেন না। একই সাথে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারানোর ঝুঁকিতেও আছেন বলে আমি মনে করি।
যখন সারাদেশে শ্রমিকশ্রেণি নিরন্ন; তখন শ্রমিক নেতা, মালিক পক্ষ ভালোই চালাচ্ছেন ‘স্টে হোম।’ মানুষ মারা যাচ্ছে না খেয়ে। এমন পরিস্থিতিতে চাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্মমম মহামারি করোনাকেও প্রতিহত করা হোক, করা হোক আসন্ন মহা অর্থ সংকট-দুর্ভিক্ষকেও প্রতিহত। তা না হলে লকডাউনে নির্মম হয়ে উঠবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন। সরকার যেহেতু তাদেরকে খাবার দিতে অপারগ, অপারগ ভর্তুকি দিয়ে বাড়ি ভাড়া সমাধান করতে, তাহলে লকডাউনের খড়কমুক্ত করা হোক। খেঁটে খাওয়া মানুষগুলোকে খাবারের সন্ধ্যানে নামার ব্যবস্থা করা হোক স্বাস্থ্যবিধি মেনে। যদিও একথা বলার কারণে অনেকেই বলবেন, তাহলে করোনার কি হবে?
উত্তরে বরাবরের মত বলবো- বাংলাদেশের যেহেতু আমেরিকার মত ৪ মাস সাধারণ মানুষকে চালানোর যোগান দেয়ার তো দূরের কথা, ৪ দিন চালানোর অর্থ-সততা- মেধা- যোগ্যতা ও ক্ষমতা নেই; সেহেতু আর এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বরং দুর্ভিক্ষে কোটি মানুষের মৃত্যুর চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে অন্তত তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরবে বয়ে চলুক করোনাকালের বিপরিতে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি