করোনা ভাইরাস আতংককে ছাড়িয়ে গেছে প্রশাসনিক আতংক। এই ভাইরাস দেহের চেয়ে মনটাকেই অসুস্থ করে তুলছে। একদিকে লকডাউন-শাটডাউন ভীতি, অন্যদিকে চাকুরী হারানোর ভীতি, আরেকদিকে অর্থাভাবে পেটের দায়। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেকেই জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন।
মানুষ যখন ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থাতেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, তখন বুঝতে হবে সেই মানুষের কাঁধে দায়ের বোঝা কত ভারী! সারাদেশ করোনা আতংকে আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ নিশ্চয় কোন প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েই বেরিয়ে এসেছে। দেশের বন্ধু নাকি প্রশাসন; অথচ রাস্তা থেকে বেরুলেই লাঠিপেটা করছে বিভিন্ন স্থানে। রিকশা, ভ্যান ও ট্যাম্পু ওয়ালাদেরকে কান ধরানোর ছবিও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়েছে। তাহলে কি সরকার জনগণের কান ধরার নির্দেশনাও দিয়েছে! যদি তা নাই হবে তাহলে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসান কোন সাহসে কয়েক বৃদ্ধ ভ্যানচালককে কানধরে উঠবস করিয়েছেন! একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে বিস্মিত আজ সমগ্র জাতি।
এ প্রসঙ্গে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছবিটি আমি দেখেছি। এটি তিনি করতে পারেন না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমাদের কাজ নয়। তাকে শোকজ করব।’ কেবল শোকজ নয়, নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে বলতে চাই, এসকল সরকারি কর্মচারীদের চাকুরীচ্যুত এবং জরিমানা করা উচিত। সরকারী কর্মচারীদের চাকুরী সংক্রান্ত কোন বিধিনিষেধ নেই বিধায় তারা নিজস্ব মনগড়া নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে, এই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। সমস্যা তো সৃষ্টি হয় তখন, যখন কোন কিছু যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন, আমরা যদি
যশোরের মণিরামপুরের ঘটনাটির দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো, ২৭ মার্চ, বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন প্রথমে দুই বৃদ্ধ।
একজন বৃদ্ধ ভ্যানচালক। পেটের দায়ে সংসারের চাল ডাল কিনতে এসেছিলেন।
এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তবে তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। এ সময় পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে সাইয়েমা হাসান শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একে মজার ঘটনা মনে করে নিজেই তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এ ছাড়া পরবর্তীতে অপর এক ভ্যান চালককে অনুরূপভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এবার জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন সম্পূর্ণ ঘটনাটি কতোটা সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারলো!
মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসানকে কয়েকবার ফোন করার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনে ভুল হতে পারে। এজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশও করেন।
তার এই দায়সারা গোছের দুঃখপ্রকাশ কী মুছে দিতে পারবে কান ধরিয়ে উঠবস করানোর অপমানের গ্লানি। এই সাইয়েমা কী কেবল তিনজনকে কান ধরিয়েছেন! তিনি কান ধরিয়েছেন গোটা বাঙালী জাতিকে, যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! লাঠিপেটা না করে, কানে না ধরিয়ে এরা কি পারেন না এইসকল দরিদ্রদের হাতে অন্ন তুলে দিতে! শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। অথচ এধরনের জঘন্য ঘটনায় উচ্চশিক্ষিত এসকল মেরুদণ্ডহীন বিবেকহীন সরকারী আমলাদের কাছ থেকে আমরা কতটুকুই বা প্রত্যাশা করতে পারি!
এবার আসি মাস্ক প্রসঙ্গে।
চীন থেকে অনেক দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এরপর পথেঘাটে, অফিসে অনেকেই মাস্ক পরছেন। ঘুরেফিরে উঠে আসছে একটি প্রশ্নই, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কতটা প্রতিরোধ করবে ফেস মাস্ক?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ফেস মাস্ক পরলেই নিজেকে নিরাপদ ভাবার সুযোগ নেই। পাতলা সার্জিক্যাল মাস্ক সাধারণ দূষণ, ধুলাবালু আটকাতে বেশি ব্যবহৃত হলেও তা পুরোপুরি নিরাপত্তা দেয় না। তবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিচর্যাকারী, চিকিৎসক, নার্স, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের এটা পরা উচিত। তবে প্রতিবার রোগীর পরিচর্যার পর ডিসপোজিবল এই মাস্ক ফেলে দিতে হবে। আধঘণ্টা পরপর পরিবর্তন করলে ভালো। মাস্কের নীল অংশটা পানিপ্রতিরোধী। আর ভেতরের (সাদা) অংশ নাক থেকে বের হওয়া পদার্থ শুষে নেয়। কেউ কাশি দিলে ভেতরের অংশটা সেটা শুষে নেয়। মাস্ক সঠিকভাবে পরা, আলাদা ঘরে বা কোণে গিয়ে খোলার পর সঠিক জায়গায় ফেলা ও ফেলার পর হাত পরিষ্কার করা উচিত।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় হঠাৎই মাস্ক ব্যবহারের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেছে। ¬রাস্তাঘাটে বের হলে বেশির ভাগ মানুষের মুখে যে সব মাস্ক দেখা যাচ্ছে, তার তালিকায় রয়েছে:
# এন৯৫ মাস্ক
# তিন স্তর বিশিষ্ট ডিসপোজাল সার্জিক্যাল মাস্ক
# গেঞ্জি কাপড় ও স্পঞ্জের মাস্ক
# কাপড়ের তৈরি মাস্ক
# ওড়না বা রুমাল বেঁধে মাস্কের মতো ব্যবহার
আসলে, কোনও কাজের কাজ হবে না এতে। জানিয়েছেন, মেডিসিন ও সংক্রামক অসুখের বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। তার সঙ্গে সহমত করেছেন বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্তও। ভায়ারোলজিস্ট সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। তাদের মতে, এই ধরনের ভাইরাস কখনওই মাস্ক দিয়ে ঠেকানোর নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন
এন৯৫ মাস্ক একমাত্র তখনই প্রয়োজন, যদি কেউ সরাসরি রোগীর কাছে থাকেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা তা ব্যবহার করবেন, যারা রোগীর এক মিটারেরও কম দূরত্বে দীর্ঘক্ষণ থাকবেন। সার্জিক্যাল বা অন্য ধরনের মাস্ক এ ক্ষেত্রে কোনও কাজে দেয় না। তবে যাদের সর্দি-কাশি হচ্ছে, তারা এই সার্জিক্যাল মাস্ক পরুন। সেটা নিজের জন্য নয়, অন্যের শরীরে রোগ না ছড়ানোর সচেতনতা থেকে। অন্য কোনও ধরনের মাস্ক আর কোনও কাজে আসে না।
বার বার মাস্কে হাত দিলে তা আরও ক্ষতি ডেকে আনে। তাঁরা আরো বলেছেন, ধুলো থেকে বাঁচতে এই সব সাধারণ মাস্ক কোনও কাজে আসে না। এই সব মাস্ক ধুলোর ক্ষুদ্র কণাকে আটকাতে পারে না। আর ধুলোর সঙ্গে করোনার কোনও সংযোগ নেই। এটা বায়ুবাহিত রোগের তালিকাতেও পড়ে না। কেউ ধুলো এড়াতে মাস্ক পরতে চাইলে তারা সার্জিক্যাল মাস্ক পরুন।
মাস্ক পরে থাকার ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এন৯৫ মাস্কের মাধ্যমে ৯৫ শতাংশ ভাইরাস মরে। কিন্তু এই মাস্ক সব সময় পরে থাকা যায় না। একটানা ১০ মিনিট পরে থাকলেও নানা সমস্যা হয়। নাক-কানে চাপ পড়ে। কানে ব্যথা হয়। একটা সময়ের পর দমবন্ধ লাগে। তাই এই মাস্ক পরলে বার বার তা নামিয়ে রাখতে বাধ্য হন মানুষ। কখনও কখনও নাকে-মুখে হাত দিয়ে তা ঠিক করতে হয়। এতেই ক্ষতি বাড়ে। মাস্ক পরার পর মাঝেমধ্যেই তা ঠিক করতে তাতে হাত দিচ্ছেন সবাই। এতে হাতের জীবাণু মাস্কে যাচ্ছে। মাস্কের উপরিভাগের জীবাণু মিশছে হাতে। ফলে কাজের কাজ তো হচ্ছেই না, বরং ক্ষতি বাড়ছে। ২০১৬ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করে। সূত্র: আনন্দবাজার
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে সেন্ট জর্জেসের ডঃ ডেভিড ক্যারিংটন বিবিসিকে বলেছিলেন, "সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক বায়ুবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম নয়"। তিনি আরও বলছিলেন, এই মাস্কগুলো এতই ঢিলেঢালা থাকে যে এটা বায়ুকে ফিল্টার করতে পারেনা ঠিকঠাক। তাছাড়া যিনি এই মাস্ক ব্যবহার করছেন, তার চক্ষু থাকছে উন্মুক্ত।
বিবিসি বাংলার নিউজের সূত্র অনুযায়ী, চীনে, যেখান থেকে শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা, সেখানেও মানুষ বায়ুর দূষণের হাত থেকে বাঁচতে হরহামেশা নাক আর মুখ ঢাকা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য বায়ুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এই মাস্ক কতটা কার্যকর সে ব্যাপারে যথেষ্টই সংশয়ে আছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা, যাদেরকে বলা হয় ভাইরোলজিস্ট।
অধ্যাপক বল বলেছিলেন, "সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সমীক্ষা চালালে যে তথ্য পাওয়া যাবে, সেটা একইরকম হবে না, কারণ দীর্ঘসময় ধরে টানা একটি মাস্ক পরে থাকা বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার"।
কুইন্স ইউনিভার্সিটি অব বেলফাস্টের ওয়েলকাম-উল্ফসন ইনস্টিটিউট ফর এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের ডঃ কনর বামফোর্ড বলেছিলেন, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেই ছোঁয়াচে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কার্যকরভাবে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, "যখন হাঁচি দিচ্ছেন তখন মুখটি ঢাকুন, তারপর হাতটি ধুয়ে নিন এবং ধোয়ার আগ পর্যন্ত মুখের ভেতরে হাত না ঢোকান - শুধুমাত্র এটুকুতেই নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ানো ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবে।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড-এর ডঃ জেক ডানিং বলেছিলেন, "যদিও একটি ধারণা আছে যে মাস্ক ব্যবহার করা উপকারী, কিন্তু বাস্তবে হাসপাতালের পরিবেশের বাইরে এই মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপকভিত্তিক উপকার পাওয়ার খুব কম নজিরই আছে"।
তিনি আরো বলেন, মাস্ক যদি পরতেই হয় এবং এটা থেকে উপকার পেতে হয়, তবে সেটা পরতে হবে সঠিকভাবে। বদলাতে হবে নিয়মিত। এবং এগুলো যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না, এক্ষেত্রেও নিরাপত্তা নির্দেশিকা মানতে হবে।
ডঃ ডানিং বলেছিলেন, সত্যিই যদি উদ্বিগ্ন হয় মানুষ, তবে তারা ব্যক্তিগত ও হাতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিলেই ভালো করবে।
ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে এনএইচএস ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর তিনটি পরামর্শ:
গরম পানি ও সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধোন।
যথাসম্ভব নিজের চোখ ও নাক স্পর্শ থেকে বিরত থাকুন।
যথাসম্ভব স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণ পালন করুন।
তাহলে হুজুগে গা না ভাসিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। মাস্ক কেন পরেনি... এই অপরাধে জাতির উপর লাঠিচার্জ অথবা কানধরানোসহ যাবতীয় অ্যাকশন প্রয়োগ করা কোন সুস্থ প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়।কাউকে বাইরে দেখলে সুন্দরভাবে এর কারণ জেনে নিন। যথাসম্ভব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। কেননা, এই দুর্যোগকালে কেউই অকারণে বাড়ির বাহিরে অবস্থান করছেন না। মনে রাখবেন, একজন দরিদ্র বাংলাদেশীর চোখের পানি কিন্তু ১৮ কোটি জনতার চোখ বেয়ে ঝরে...
শান্তা ফারজানা : প্রতিষ্ঠাতা, সাউন্ডবাংলা স্কুল ও সম্পাদক, বাংলারিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম