কুয়াকাটায় সৈকত ঘেঁষা সাগরের ৩৪ কিলোমিটার অগভীর এলাকা এখন চাঁদাবাজদের দখলে। খাজুরা থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত সাগরের এই বিশাল এলাকাজুড়ে স্থানীয় একটি চক্র ফি-বছর জেলেদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এক যুগ ধরে চলছে এ অভিনব এমন চাঁদাবাজি। এচক্রের আবার এরিয়া ভাগ করে ইউনিট লিডার করা হয়েছে। একেক ইউনিটের টাকা আদায়ের জন্য ইউনিট ক্যাডার রয়েছে। জেলেরা টাকা না দিলে মারধর থেকে শুরু করে নৌকার ইঞ্জিন খুলে নেয়া হয়। এমনকি সাগরে জাল পাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতিসম্প্রতি (২৪ আগস্ট) কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগান এলাকার ১৯ নৌকার জেলেরা এমন চাঁদাবিাজির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এ ঘটনার জন্য কুয়াকাটা আশার আলো সমবায় সমিতির নেতৃবৃন্দকে দায়ী করেছেন।
কুয়াকাটায় সাগরের প্রায় সাত কিলোমিটার সাগর অভ্যন্তরে (অগভীর এলাকায়) যারা ইলিশ শিকার করে তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় খুটা জেলে বলা হয়। কারণ একটি নির্দিষ্ট সাইজের জাল দুই দিকে খুটার সাহায়্যে জেলেরা দিনরাত পেতে রাখে। একটানা ১৫-২০ দিন এই জাল পাতা থাকে। একেকটি নৌকার জেলেরা সাগরের নির্দিষ্ট এলাকায় জাল ফেলতে পারবে এমন বাধ্যবাধকতা করে দেয় এই সিন্ডকেট। একটি নৌকার জেলেরা ১৪০ থেকে দেড় শ’ হাত প্রস্থ এলাকায় জাল পেতে রাখে। এভাবে প্রতি নৌকার জেলেদের ২০-২৫টি জাল পাতা থাকে। জাল পাতার এই নির্দিষ্ট স্থানকে জেলেরা ‘গাতা’ বলে থাকে। প্রতিদিন ভাঁিটর সময় নৌকা নিয়ে জেলেরা জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে আনে। একেকটি নৌকায় ৪/৫জন জেলে কাজ করে থাকে। একটি খুটা জেলে নৌকা ঘিরে গড়ে চার-পাঁচটি পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। আল্লাহর দেয়া এই প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশ আহরনের সাগরও এখন চাঁদাবাজদের দখলে। ফি বছর মৌসুম ভিত্তিক একেকটি নৌকার জন্য চাঁদাবাজ ওই চক্রকে দিতে হয় তিন শ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। এভাবে অন্তত ছয় শ’ খুটা জেলের নৌকা থেকে বছরে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কমপক্ষে লাখ টাকা। অসহায় জেলেরা জানান, তারা চার/পাঁচ জনে একটি নৌকাসহ জাল নিয়ে সাগরে নামলে খরচ হয় প্রায় দুই-আড়াই থেকে চার লাখ টাকা। এ টাকার অধিকাংশ আড়ত মালিকদের কাছ থেকে দাদন নেয়া হয়। দীর্ঘদিনেও এই চাঁদাবাজি বন্ধে কেউ কোন উদ্যোগ নেয়নি। সরকারি দলের নাম ব্যবহার করে স্থানীয় একটি চক্র এমন চাঁদাবাজি করলেও জেলেরা এদের ভয়ে তটস্থ থাকছে। দরিদ্র জেলেরা এদের কবল থেকে মুক্তি পেতে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতোপূর্বে কখনও প্রতিবাদ করেনি। দেয়নি কোথাও কোন অভিযোগ। এক মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, খাজুরা থেকে কাউয়ার চর পর্যন্ত ছয়টি ইউনিট করা হয়েছে। এর পাঁচ নম্বর ইউনিটের কালেকশন করেন আবদুর রব হাওলাদার ও জাহাঙ্গীর। গভীর সাগরে মাছ আহরনকারী কুয়াকাটা-আলীপুর ট্রলার মৎস্য মালিক সমিতির সভাপতি ও লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা জানান, খুটা জেলেরা তার কাছেও এমন অভিযোগ করেছেন।
কুয়াকাটা আশার আলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি নিজাম উদ্দিন শেখ জানান, তাঁদের সমিতির প্রকৃত শেয়ার-সঞ্চয়ধারী সদস্যের সংখ্যা ১০০ জন। তবে তাঁদের সমিতির আওতায় চার শ’ খুটা জেলে রয়েছে। এরা সাগরে জাল পাতার জায়গা বাছাই নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ে। যা নিরসনে তারা ছয়টি ইউনিটে তাঁদের নির্ধারিত লোক রয়েছে। যারা জায়গা বন্টন করে শৃঙ্খলার সঙ্গে মাছ ধরার সুযোগ করে দিয়ে আসছে। এজন্য জেলেদের জায়গা শনাক্ত করতে নৌকার ইঞ্জিনের তেল খরচ বাবদ সর্বোচ্চ ২০০ টাকা দিতে হয়। আর চাঁদাবাজির কোন সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ মিথ্যা। এদিকে খুটা জেলেদের এমন সমস্যা নিরসনে বুধবার সন্ধ্যায় খুটা জেলেদের নিয়ে পটুয়াখালী জেলা পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে কুয়াকাটা পর্যটন ইয়ুথ ইন মোটেল মিলনায়তনে এক যৌথ সভা করা হয়েছে। সেখানে (পটুয়াখালী হেড কোয়ার্টার্স) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ বিল্লাল হোসেন, স্থানীয় মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা, কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব উপস্থিত থেকে জেলেদের এই সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছেন। নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সাগরে জাল পাতার জন্য সকল জেলের জন্য সমপরিমান এরিয়া নির্দিষ্ট করতে হবে। এজন্য কোন টাকা আদায় করা যাবে না। অপেশাদারী কেউ জেলেদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না, এমন নির্দেশনা নিশ্চিত করতে পুলিশের তদারকি থাকবে বলেও মহিপুর থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান নিশ্চিত করেছেন।