আইনের রক্ষক হয়েও পুলিশ বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য নানা অপরাধজনিত অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। তাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের পরিবর্তে পুলিশ বাহিনীর সুনাম বিঘিœত করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের অসাধু সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে এবার সরকার পুলিশ বাহিনীতে কঠোর শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অপরাধের ধরন অনুযায়ী শ্রেণীভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। ঘুষখোর, তদবিরবাজ, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারে জড়িত ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়কারী, ক্ষমতা অপব্যবহারসহ নানা ধরনের অপরাধ অনুযায়ী তালিকাটি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই উর্ধ্বতন ৩০ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৬ সালে সিকিউরিটি সেলে সারাদেশ থেকে ১৩ হাজার ৬শ’ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে ছিল। আর ২০১৭ সালে ওই সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৬ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় এবং ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশ সদস্যের ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক। কারণ কিছু পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হতে দেয়া যায় না। প্রয়োজনে তাদের বাহিনী থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। সেক্ষেত্রে কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। তবে পুলিশ সদর দফতরের ভাষ্য মোতাবেক, পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগই সৎ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে। বিশেষ করে গত ১০ বছরে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে। যা দুর্নীতির উৎস বন্ধের অন্যতম একটি ধাপ। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযানের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও পরিকাঠামো গঠনের কাজ চলছে। ওই মোতাবেক সারাদেশে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এবারের তালিকা হবে অপরাধীদের মতো। যেমন ছিনতাইকারী, ডাকাত, খুনী, অস্ত্র ব্যবসায়ী বা মাদক ব্যবসায়ীদের যেভাবে পৃথক পৃথক তালিকা করে পুলিশ। ওই একই পদ্ধতিতে পুলিশের ঘুষখোর, তদবিরবাজ, পদোন্নতি ব্যবসা, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবনকারী ও মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়সহ নানা শ্রেণীতে ভাগ করা হবে। যে পুলিশ সদস্য যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবে, তাকে সেই তালিকায় রাখা হবে। আবার যারা একাধিক ধরনের অপরাধ করবে তাদের নাম শ্রেণীভিত্তিক একাধিক তালিকায়ও থাকবে।
সূত্র জানায়, সরকারের তরফ থেকে প্রতিটি বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। যার মধ্যে পুলিশ বাহিনী অন্যতম। কারণ সারাদেশে পুলিশের নেটওয়ার্ক রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সদস্যের এই বাহিনীর চেন অব কমান্ড সঠিকভাবে ধরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। সে মোতাবেক বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা শাখাকে আরো শক্তিশালী ও ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়। সর্বশেষ কক্সাবাজারে সিনহা হত্যার পর সেই বিষয়টি আবারো সামনে চলে এসেছে। আর সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পরেই পুলিশ মহাপরিদর্শক পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিশেষ এক ঘোষণা জারি করেন। তিনি বলেছেন, যারা পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করে রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হবেন বলে ভাবছেন বা সেই লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের পুলিশ বাহিনীতে জায়গা নেই। তারা ইচ্ছে করলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, যেসব পুলিশ সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেন পুলিশ প্রধান ও ডিএমপি কমিশনার। পুলিশ বাহিনীতে ডোপ টেস্ট চালু করার প্রক্রিয়াও চলছে। যা চাকরির আগে এবং পরেও করা হবে। কোন পুলিশ সদস্যের প্রতি সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট বা মাদকাসক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হবে। যার রক্তে বা দেহে মাদক সেবনের আলামত পাওয়া যাবে, তাকে চাকরিচ্যুত করতে ন্যূনতম ভাবা হবে না। শুধু তাই নয়, নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের সঙ্গে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার শাস্তিও নিশ্চিত করা হবে। সেক্ষেত্রে কোনো দোহাই মানা হবে না। এখন এমন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ৩০ পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তাছাড়া যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। এবারই প্রথম অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরেই তাদের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সে বিষয়ে একটি পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। যার মধ্যে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর পুলিশে আবারো শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন অনুভব করা হচ্ছে। সম্প্রতি নানা অপকর্মে দুই শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বরখাস্তসহ নানা ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে ৫০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। সেসব অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সম্প্রতি অভিযোগের হার আরো বেড়েছে।
এদিকে অনেক আগেই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নিজ দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর ঘোষণা দেয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে ‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটক করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ঢাকার ক্যাসিনোগুলোর নিয়ন্ত্রক ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে স¤্রাট, তার সহযোগী কাউন্সিলর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমান, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম ওরফে সোহেল, ক্যাসিনো ব্যবসার বাইরে ঠিকাদারি থেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক জি কে শামীম, গেন্ডারিয়া আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ও তার সহোদর ভাই রূপন ভূঁইয়াকে। তাদের কাছ থেকে বিপুল স্বর্ণ ও অর্থ জব্দ করা হয়। গ্রেফতারের পর দল থেকে তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তার আগে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই ডেসটিনির রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসেনসহ প্রতিষ্ঠানটির ২২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে দুদক। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ (এমএলএম) ও ট্রি-প্ল্যান্টেশন প্রকল্পের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে। হাসপাতালের পর্দা কেনার নামে ১০ কোটি টাকা, রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশ কা-ের সঙ্গে জড়িতদেরও গ্রেফতার করা হয়। কাউকেই ছাড় দেয়া হয়নি।
অন্যদিকে পুলিশ বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মোঃ সোহেল রানা জানান, পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিট ঢেলে সাজানোর নির্দেশ জারি করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক। অপেক্ষাকৃত সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা শাখা গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, পদোন্নতি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কর্মকান্ডে যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত থাকবে তাদের কপালে নিশ্চিত দুঃখ আছে।