একটি বামপন্থী দলের অফিসে একদিন সন্ধ্যাবেলা বস্তি উচ্ছেদ সম্পর্কিত মুক্ত আলোচনা সভায় বক্তাদের মূল্যবান কথাবার্তার শেষে মতামত জানাতে গিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। বক্তব্য ছিল এই রকম: বস্তিবাসীরা বাস করে অন্যের ঘরে ও অন্যের জমিতে। ঘর তাদের নয় আর যে জমিতে তাদের বাস অর্থাৎ ঘর রয়েছে তাও তাদর নয়। সুতরাং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী জমির মালিক অর্থাৎ সরকার তার নিজের জমি দখল বুঝে নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী জমির মালিক অর্থাৎ রাষ্ট্রের স্বার্থে তার আইন প্রয়োগকারী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলেছে অবৈধ দখলকার অমালকি ব্যক্তিবর্গকে উচ্ছেদ করার জন্য। আমি জানালাম যে এটা তরারা ঠিকই করেছে। কারণ তারা নিষ্ঠাবান কর্মচারীরর মত সরকারি আদেশ পালন করেছে। সবাই হকচকিয়ে উঠল। প্রশ্ন তুললাম, ঢাকা শহরে জমির মালিক কারা? যারাই জমির মালিক হোক, এ শহরে বসবাসকারীর প্রাথমিক অধিকার তাদেরই যাদের শ্রমে ও ঘামে এ শহরকে বাসযোগ্য ও সুন্দর করে তোলা হয়েছে। সুতরাং বস্তিবাসীদের সমস্যা নিরসন করার জন্য প্রথমে নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা প্রয়োজন জমির মালিকানার বিষয়টি। মালিকারান বিষয়টি পরিস্কার করা প্রয়োজন। এ মালিকানা কি আলাদা আলাদা ভাবে কতিপয় ব্যক্তির হবেৎ, না সম্মিলিত ভাবে হবে সকলের ? এ প্রশ্নের মিমাংষা না-করা পর্যন্ত বস্তিবাসীদের বসবাসর বা বাসগৃহের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে “৪২(১) আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলক ভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না। সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানার অধিকারকে নিরঙ্কুশ ও অমোঘ করা হয়েছে। সেখানে ব্যক্তির মালিকানাধীন অথভা ব্যক্তিবর্গের মালিকানাধীন জমিতে অনুপ্রবেশ করে ঘর বেঁধে বসবাস করা অবৈধ ও আইনবহির্ভূত। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে অনুপ্রবেশ করে ঘর বেঁধে বসবাস করা অবৈধ ও আইনবহির্ভূত। ব্যক্তিমালিক অথবা ব্যক্তিবর্গ-মালিক তার বা তাদের সম্পত্তিতে বা জমিতে অবৈধ অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আদালতের কাছে যেতে পারে। কোর্ট, পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলতে পারে বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের আরজি মোতাবেক অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে প্রয়োজন মাফিক শক্তি প্রয়োগ করে হঠিয়ে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশ সরকার খাস জমি ও ব্যক্তিগত মালিকানার পতিত জমি বেদখল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেবে। ব্যক্তিগত-সম্পত্তি-ভিত্তিক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং বস্তিবাসীরা অন্যের মালিকানাধীন জমিতে কুঁড়ে, ডেরা বা ছাপরা তৈরি করে মাথা গুঁজবে তা এ সমাজে কাম্য হতে পারে না। মানবাধিকারবাদীরা বলে থাকেন যে প্রত্যেক মানুষেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার অধিকার এবং এই অধিকার কায়েমের জন্য প্রয়াস চালাবার অধিকারও তার রয়েছে। তার জন্য শ্রমজীবী জনগণের সম্পত্তির মালিকানা যুক্ত নতুন সমাজ গড়ে তোলা দরকার। এই সম্পত্তি মালিকানা রসূত্র ধরেই কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের শেষ অংশে আছে ‘এই সমস্ত আন্দোলনে তারা প্রত্যেকটির প্রধান প্রশ্ন হিসাবে সামনে এনে ধরে মালিকানার প্রশ্ন, মালিখানার (অবশ্যই সম্পত্তির মালিখানা-লেখক) বিকাশের মাত্রা তখন যাই থাকনা কেন।’
এই বক্তব্যের পরে একজন তরুণ জানতে চাইল আসলে বক্তা কি বলতে চাইছে। সে বুঝতেই ্পারেনি যে-জমির মালিকানা নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয়েছে তখন একজন কমিউনিস্ট হিসাবইে সম্পত্তির মালিকানার প্রশ্নটিকেই সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কমিউন্সিট মতাদর্শ অনুরারে সম্পত্তির মালিকানার ব্যবিÍগত রূপকে ধ্বংস করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্টা করাই হল কমিউনিস্টদের কাজ। এই বক্তব্যটাই হাজির করার প্রয়োজনে শ্রোতাদের চিন্তাকে উস্কে দেওয়াররে জন্যই জমির মালিকানার প্রশ্নটিকে সামনে আনা হয়। তরুণটি মতামত প্রকাশ করল যে, ঢাকা শহরে জমির সিলিং নিয়ে একটা আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। তার চিন্তা এর বেশি আর এগায়নি। কারণ সম্পত্তি মালিকানার বিষয়ে কমিউন্সিট পার্টি নেতৃত্বের চিন্তাই একটি বিশেষ তারে বাঁধা। তরুণ কমিউন্সিট নেতা আগাম ধারণা করতে পারেননি যে, যা-হারে সামাজিক অস্থিরতা বাড়রছে, অবৈধ জমি দখলের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, জীবিকা ও অন্যান্য ধান্দায় শহর ও নগরে যে-হারে জনসমাগম হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষি ও অন্যান্য উৎপাদননী খাতে সামঞ্চস্যহীন শ্রম সরবারহ ঘটছে বা শ্রম সরবরাহের শূন্যতা দেখা দিচ্ছে, চল্লিশ বছরে তৈরি করা যান্ত্রিক কৃষি উপকরণের চাহিদা রোদে-পোড়া কৃষকের চেহারা নিয়ে অপ্রতুল সরবারহের সামনে শূন্য ভান্ড হাতে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে ্গাামী দিনগুলোতে পেটের ভাত যোগাড় হবে কি করে; বিদেশী জ¦ালনি তৈল, বীজ কৃষি যন্ত্রপাতির সাহায্যে, তোলা দুধ দিয়ে পোলা বাঁচানোর মত কৃষিকে বাঁচানোর মত কৃষিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে আগামী দিনগুলোতে পেটের ভাত যোগাড় হবে কি করে; বিদেশী জ¦ালানি তৈল, বীজ, কৃষি যন্তপাতির সাহায্যে, তোলা দুধ দিয়ে পোলা বাঁচানোর মত কৃষিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে যাতে করে পেটের ভাত যোগার-সমস্যার সামাধন করা যায়, তিনি ধারণা করতে ভয় পান ভূসম্পত্তিরমালিকানা নিয়ে জনজীবনে আরও বিশৃঙ্খলা (?) দেখা দিলে শান্তিপূর্ণ রাজনীতির পরিবেশে(!) বজায় থাকবে কি না, শোষকগোষ্ঠী দেশটাকে লুন্ঠন করে সা¤্রাজব্যবাদীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাবে কি না ইত্যাদি। গ্যাস কূপ খননের জন্য উৎপাদনী অংশীদারি চুক্তি করতে গিয়ে যেভাবে গোপনে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে উপরের সম্ভাবনাগুলো জোরদার হয়েছে বেশি, জাতীয় সম্পত্তি ও সম্পদের ওপর জনগণের সার্বভৌম মালিকানা ক্ষুন্ন হবে একথা ভাবতে সকলরেই ভয় হয়।
কয়েকদিন পরে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির মুখপত্র বলে কথিত সাপ্তাহিক পত্রিকায় দেখলাম মুক্ত আলোচনা বিষয়ক সংবাদে সম্পত্তি মালিকানা সম্পর্কে কোন বক্তব্যই ছাপা হয়নি। ‘বাংলাদেশ বিগত তিন দশকের রাজৗণতিক আন্দোলন’ বিষয়কে আলোচান সভায় বলা হয়েছিল, বিগত তিন দশকে বিশেষ করে বিগত আশি বছরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে তথা বাংলা অঞ্চলে অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, অনেক মানুষ অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করেছেন, অনেক মানুষ মৃতুবরণ করেছেন কিন্তু গণতান্ত্রিক বিপ্ল সম্পন্ন হয়নি। গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না-হওয়ার কারণ হিসাবে শ্রমজীবী শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্ব পর্যায়ে অশ্রমিক ও অচাষী শ্রেণীর লোকদের বিপুল সংখ্যাদিক্য ও প্রাধান্যের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এই বক্তব্যের পরে বিশ্বদ্যিালয় পড়-য়া এক মেয়ের বক্তব্য ছিল যে, বাংলায় অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে অনেক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পরে অনেক অনেক পুরাতন রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তন হয়েছে, অনেক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে, সভাসমিতি, সমাবেশ করার অধিকার, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনেক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসছে, অর্থাৎ তার ভাষায়গণতান্ত্রিক বিপ্ল সম্পন্ন হয়েছে।
অবশ্য মেয়েটির উপলব্ধি ও প্রশ্নবিদ্ধ ধারণা একবারে ভিত্তিহীন ও অমূরক নয়। পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসছে তখন নিশ্চয়ই গণতন্ত্র এসছে। বিএনপি জামাতের কর্মী সমর্থকগণ ভেবেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর আওয়আমী লীগ কর্তৃক অত্যাচার নির্যাতনের পর ১৯৭১ এর ‘গন্ডগোল’? এর সময়কার পাকিস্তান ধারণার পক্ষাবলম্বরকারী জামায়াতে ইসলাম সহ বিএনপি যখন আবার ক্শতায় এসছে তখন অবশ্যই গণতন্ত্র এসছে। বিজয়ের আনন্দে সকলেই ভুলে গেছে (১) ১৯৭১ এর খুন, লুটপাট, ধর্ষণ, হয়রানির কথা, (২) ১৯৮৭- তে চট্টগ্রামে গণসমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত মানুষদের কথা; (৩) ১৯৯৪-৯৫ এ সার -এর জন্য কৃসক আন্দোলনে নিহত ১৭ জন মানুষের কথা; (৪) পুলিশ এর ট্রাকের চাপায় নিহত ছাত্র নেতাদের কথা; (৫) ফেনীর অরাজকতা, উত্তরার সন্ত্রাস আর ওসমানি উদ্্যানের সবুজ প্রকৃতির শ্রীহারার বেদনার কথা; (৬) মালিবাগের প্রকাশ্যে রাজপথে পুলিশ আর সন্ত্রাসীদের গুলীতে নিহত মিছিলকারীদের কথা। আমাদের কথার সাথে কাজের সামঞ্চস্য ঘটাতে পারিনি। আমাদের মধ্যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে পারিনি। প্রকৃত উৎপাদক শ্রমিক চাষী ও তাদের পক্ষের বুদ্ধিজীবী তথা কায়িক ও মানসিক শ্রমজীবীদের নিকট উৎপাদন ও বিতরণের উপায় তথা সম্পত্তি ও সম্পদ হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেনি।
মার্কস্বাদীদের মতো গণতান্তিওক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে অনেকেরই কোন সুস্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকেই দুটি শব্দের অর্থের মধ্যে সীমারেখা টানতে অপরাগ। সভা-সেমিনারে অনেক নাট্যব্যক্তিত্ব বলেন, রাজনীতির ভাষা পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজনীতির ভাষা সহজ ও গণমুখি হওয়া দরকার যাতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ রাজনৈতিক বক্তব্যকে যথাযথভাবে বুঝতে পারে ও গ্রহণ করতে পারে। এটা অনেকেই বলেন যে বামপন্থী অথবা সমাজতান্ত্রীক রাজনীতির ভাষা, যেমন গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি অনেকেই বুঝতে পারেন না। এ বিষয়ে কিছু কথা পরিস্কার করে বলা দরকার বলে অনেকে মনে করেন।
মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ- এর ভাষায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লব এক অর্থ বহন করেনা। দুটি খুব কাছাকাছি কিন্তু দুটি আলাদা বস্তু ও আলাদা ঘটনা। সম্পর্কটা এই সূত্রে যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিমাণগত রুপ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে গুণগত রুপে পৌছাতে পারে অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রুপান্তরিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে উপরি-কাঠামোতে লোকভোলানো ছিটেফোটা সংস্কার হয়, যেমন ১৯৩৭ সালে সম্পত্তি মালিকদের ছয় আনা ট্যাক্স-ভিত্তিক ভোটারের ভোটে নির্বাচন হয়। যে ব্যক্তি ছয় আনা ট্যাক্স দিতে পারে কেবল সেই ভোট দিতে পারে। জয়লাভ করে কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ফজলুল হক বাংলা প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার কিছুটা পরিবর্তন হয়। এগুলো গণতান্ত্রিক বিপ্লব নয়, গণতান্ত্রিক সংস্কারের ফল। ফজলুল হক-এর নেতৃত্ব যদিও ফ্লাইড কমিশন জমিদারি ও মধ্যস্তত্ব ব্যবস্থা উচ্ছেদের সুপারিশ করেছিলে কিন্তু তখনো জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ হয়নি অর্থাৎ তখনো ভূমি-প্রশাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়নি অথবা ভূমি মালিকানা ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়নি। ভূমি মালিকানা ব্যবস্থা মৌলিক পরিবর্তন না হলে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কোন পরিবর্তনকেই গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে ধরে নেওয়া যাবে না। ভূমি মালিকানা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন হলে, প্রথম প্রকার : সকল মধ্যস্বস্তে¡র বিলোপ অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তি ও চাষীর মধ্যে তৃতীয় কোন মালিকানা বা স্বত্বধিকারী না থাকা: দ্বিতীয় প্রকার হল: সকল জমি সরাসরি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে নিয়ে আসা।
১৯৪৬ সনে বাংলা অঞ্চলে পাকিস্তান ধারণার পক্ষের (সাম্প্রদায়িক) রাজনৈতিক দল প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করে। ১৯৪৭ সনের ১৪ আগষ্টের পর উপর্যুক্ত দলের অধিকতর সাম্প্রদায়িক অংশ পূর্ববাংলা প্রদেশে ক্ষমাতাসীন হয়। কিন্তু তখনো ভূমি-ব্যবস্থায় জমিদারি,তালুকদারি ইত্যাদি মধ্যস্বস্ত¡ প্রথা টিকে থাকে। ১৭৬৫ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মূলত কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাংলার প্রকৃত শাসক-শক্তিতে পরিনত হয়। সে-ঘটনার প্রায় ত্রিশ বছর পরে ১৯৭৩ সালে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবতির্ত হয়। খাজনা/রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদার নিয়োগ করে তাদের সাথে চুক্তিকরা হয়। খাজনা/রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদার নিয়োগ করে তাদের সাথে চুক্তি করা হয়। খাজনা/রাজস্ব আদায়কারীরা মেকি সামন্ত প্রভু সেজে যায়। অল্পকিছুদিনের পূর্বের আমলের রাজা নওয়াবের মত ঠাঁট-বাঁট নিপীড়ন চালায়,রায়ত/প্রজাদের উপকার করতে পারুক আর নাই পারুক! তাদের আচার-আচরণ নকল করে অমিত শক্তিমত্তা ও প্রভূত্বের মহড়া দেয়। রাজা নওয়াবদের সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির ঠাঁট-বাঁট (পাতিসামন্ততন্ত্রের সুপাষ্ট্রাকচার বা উপরিকাঠামো) দ্বারা ইংরেজগণও প্রভাবিত হয়েছিল। পাতিসামন্ত সংস্কৃতির ওই ধারা পঞ্চাশের দশকের জমিদারি উচ্ছেদ পর্যন্ত চলে। বাংলা অঞ্চলে কোন কালেই ইউরোপীয় ধরনের সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। অন্যের ইচ্ছাকে অবদমিত করে নিজেকে একচ্ছত্র হিসাবে প্রকাশ করায় যে-প্রবৃত্তি বাংলা অঞ্চলের বলপ্রয়োগকারী ভূম্যাধিকারীদিগের মধ্যে দেখা যায় তা সামন্ততন্ত্র নয়; স্বেচ্ছাচারিতা মাত্র। তা বরং পাতিসামন্ততন্ত্র নামক এক উৎপাদন পদ্বতির জন্ম দেয়, যে পাতিসামন্ততন্ত্র নিজের শক্তিপ্রয়োগের সীমারেখায় নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারী কিন্তু অন্যের এলাকায় ভদ্রচারী। (গণতান্ত্রিক?)।
১৯৫০ সালে জমিদারী ব্যবস্থা অথিগ্রহণ করা হয়। পূর্ব বাংলা থেকে জমিদার-তালুকদারদের মধ্যে সংখ্যায় অত্যন্ত গরিষ্ঠ হিন্দুদেরকে খেদিয়ে তাদের জায়গাজমি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য মুসলিম লিগাররা দ্রুত জমিদারি ব্যবস্থা অধিগ্রহণ আইন পাস করে। কিন্তু অন্য সকল মধ্যস্বস্ত¡ উচ্ছেদ করা হয়নি। উল্ল্যখ্য যে-মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বানুসারে ভূমি মালিকানায় পরিবর্তন গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ভিত্তি, একই বস্তুর অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের যথাক্রমে অর্থনৈতিক রুপ ও রাজনৈতিক রুপ। অর্থনৈতিক পরিবর্তনটা অবকাঠামো আর রাজনৈতিক পরিবর্তনটা উপরিকাঠামো। রাজতন্ত্র জমিদারতন্ত্র খতম হলে ভূমি মানিকানায়ও যেমন পরিবর্তন হয়, রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও বংশানুক্রমিকভাবে নির্ধারিত ব্যক্তির স্বেচ্ছায়তন্ত্রের বদলে আসে গুঠিকয়েক অভিাজাতের তন্ত্র অথবা অনেক বেশি সংখ্যক ব্যবসায়ী,পুজিঁপতি, ধনিকের তন্ত্র বা শাসন। রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের একটি আর একটির পরিপূরক। আসল কথা, ভূমি মালিকানার মৌলিক পরিবর্তন বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের মূল শর্ত ও ভিত্তি।
গণতান্ত্রিক বিপ্লব হল উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রুপান্তর। উৎপাদন সম্পর্কে মানে বৈষয়িক সম্পদের উৎপাদন,বিনিময় ও বন্টনের প্রক্রিয়ার জড়িত মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটাই উৎপাদন সম্পর্ক। এটা উৎপাদনের উপায়ের মালিকানায় ধরনের উপর নির্ভর করে। উৎপাদিবা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক মিলে গঠিত হয় উৎপাদন প্রণালী বা উৎপাদন পদ্বতি। সামন্ততন্ত্র তথা বাদশাহ বা স¤্রাটের আনুগত্যাধীন রাজা, নওয়াব,জায়গিরদার, জমিদার ও তালুকদার ও জোতদারদের তন্ত্র বা উৎপাদন ও শাসন-ব্যবস্থার পরিবর্তে ধনিক বণিক শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের তন্ত্রে বা শাসন-ব্যবস্থায় রুপান্তর হলে বুর্জোয়া বা শহরবাসী/নগরবাসী ধনিকদের শাসনে রুপান্তর বা পরিবর্তন, অন্য কথায় এ হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। গণতন্ত্র কি তা খুব সাধারণ ভাবে এটা এখন সকলেই বুঝে। সাধারন মানুষ বুঝে যে গণতন্ত্র মানে ভোট দেওয়ার অধিকার (অর্থাৎ ভোটতন্ত!)। কিন্তু বিগত পয়শট্টি বছর ধরে ভোটতন্ত্র (১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইন অনুসারে এদেশে প্রথম বিধান পরিষদিয় নির্বাচন হয়) চর্চা হলেও প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চাটা জীবন খুব বেশি হয়নি।
হওয়ার কথাও নয়।
বাংলাদেশের চলমান জীবনের গতি-নিয়ন্ত্রক যে-অর্থনীতি তাতে গণতন্ত্র নেই। অনুপস্থিত ভূস্বামী জমি পতিত ফেলে রাখে বা চাষ করায়না, বর্গচাষী জীবিকার প্রয়োজনে চাষ করলেও জমি মালিকের তাতে নজর থাকো না, নজর থাকে ফসল পাকার পর ভাগের ভাগ পাওয়ার দিকে, কারখানা মালিক কারখানা লে-অফ বা বন্ধ রাখে, নির্দিষ্ট সময়ে প্রদেয় বেতন বন্ধ রাখে, বেতন দেয় না। কারখানার খাতাপত্র শ্রমিক বেশি দেখিয়ে বাস্তবে কম শ্রমিক নিয়োগ করে ভূয়া বিবরণ দাখিল করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয়, কিন্তু কারখানা বাড়ায় না, অথচ চাষী বা মজুর কাজ পায়না, কাজের অভাবে টাকা রোজগার করতে পারে না, খাদ্য কিনতে পারে না, না খেয়ে মরে। কাজ পাওয়ার অধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। ইউরোপ আমেরিকায় কাজ না-থাকলে সামান্য বেকার ভাতা দেওয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে বেকারভাতা তো দূরের কথা, বেকার শ্রমজীবীর দিকে চোখ পড়বার আগেই চোখ উল্টোদিকে/অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়া হয়।
উদাহরণস্বরুপ, কালো ধুয়ার দ্বারা পরিবেশ দূষনের অজুহাতে প্রায় বিশ হাজার পুরানো যাত্রীবাহী বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে এক লাখ লোক বেকার হয়। অথচ অধিকাংশ গাড়ির মেশিন থেকে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রটি বদলে ফেলে কালো ধূয়া বের হওয়া ক্রটি সারানো যায় বলে অভিজ্ঞ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারগণ অভিমত প্রকাশ করেন। এতে সংশ্লিষ্ট মালিক গাড়ি পুনসংস্থানের খরচ থেকে তুলনামূলক কম ক্ষতির সম্মূখীন হন। তার চেয়েও বড় কথা, গাড়ির ক্রুটির ব্যাপারে পরিবহন শ্রমিবগণ কোন অবস্থাতেই দায়ী নন। এ ব্যাপারে শতকরা একশত ভাগ দায়ী হল মালিক, সরকারি কর্তপক্ষ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা ও পুলিশ। পুরানো গাড়ি বন্ধের জন্য সরকার সার্কুলার জারি করে। সার্কুলার জারির সাথে সাথে রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ গাড়ি বন্ধের জন্য সরকার সার্কুলার জারি করে। গাড়ি বন্ধের সাথে সাথে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যায়। অধিকাংশ শ্রমিক অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়। এতে শ্রমিকের কাজ করে খাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়। এটা আন্তর্জাতিকশ্রম আইন সাথে সংগতিপূর্ন নয়। বিষয়টি শ্রম আদালতে বিচারযোগ্য। সরকারী সার্কুলার জারির দিন থেকে চাকরিচ্যুত শ্রমিকগণ ক্ষতিপূরণ পাবার যোগ্য। কিন্তু পাতিসামন্ততন্ত্রী উপরিকাঠামোর পরিবেশ লালিত সরকারি বেসরকারি রাজনীতিবিদ ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে উদাসীন। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ পাটকল বন্ধ নয়, বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। স্থায়ী,অস্থায়ী ও বদলি শ্রমিক সহ প্রায় একত্রিশ হাজার শ্রমিককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করে মিল কর্তৃপক্ষ দ্বারা আদেশ জারি করানো হয়। মাত্র ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের নোটিশে মিলটি স্থায়ীভাবে ‘লে-অফ’ ঘোষনা করা হয়, যা গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।