সময়ের সাথে আর্থিক খাতে সাইবার প্রতারণা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশ্বের অন্তত ৯৯টি দেশে বড় ধরনের সাইবার হামলার পর আবারও আলোচনা হচ্ছে হ্যাকিং ও হ্যাকারদের নিয়ে। বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বে বহু হ্যাকার সারাক্ষণই বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিং, সরকার ও সংস্থার ওয়েবসাইট, কম্পিউটার সিস্টেম এমনকি ব্যক্তিগত কম্পিউটারও হ্যাক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতারণা ঠেকানোর জন্য আমরা নতুন নতুন ব্যবস্থা নেয়ার কথা শুনি, কিন্তু কার্যত কিছু হচ্ছে না। আর্থিক খাতের সাইবার প্রতারণা কে কোনো মতেই ঠেকাতে পারছি না। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হওয়ার পর আমরা সত্যি সত্যিই উপলব্ধি করলাম, আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার অপরাধ সিন্ডিকেটগুলোর কাছে যেন নস্যি। এই ঘটনা প্রমাণ করে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তার জন্য আমাদের আরো অনেক কিছুই করার বাকি। তবে এ ঘটনা আরো প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে শুধু এ দেশের একক উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। এর জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। কারণ, সাইবার অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে নানা আর্ন্তর্জাতিক চক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাও এ সত্যেরই প্রমাণ। তবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনার পাশাপাশি নিজেদের প্রস্তুতি জোরদার করার দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমরা কতটুকু পেরেছি, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ, আমরা যে যা-ই বলি, দেশের আর্থিক খাতে সাইবার অপরাধ বেড়েই চলেছে। অতীতের ও অতি সাম্প্রতিক সাইবার অপরাধচিত্র আমাদের সে বার্তা দেয়।
এদিকে, করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ^ব্যাংক। এ সময়ে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে অর্থের লেনদেন স্বাভাবিক ব্যাংকিংয়ের চেয়ে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ওপর বেশি নির্ভরশীল। এতে প্রচলিত আইনকানুন মানা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। আবার অনলাইন ব্যাংকিংয়ে ব্যাংকগুলোর তদারকি কার্যক্রম কম হয়। এ দুর্বলতার আড়ালে অর্থ ব্যয়ে মানি লন্ডারিং, অর্থ পাচার, জালিয়াতিসহ বহুমুখী অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে এমনটাই মনে করছে অর্থনীতিকরা। সন্ত্রাসী কাজে কেউ যেন অর্থের ব্যবহার করতে না পারে সেজন্যও সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে। সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিকভাবে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) প্রতিবেদনে এ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি এফএটিএফের সদস্যভুক্তদেশগুলোর মতো বাংলাদেশেরও একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, করোনার সময়ে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ফলে ডিজিটাল লেনদেন বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি নিশ্চিত হতে হবে। অনুদানের অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। পাশাপাশি করোনা আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। গ্রাহককে না দেখেই শুধু অনলাইন বার্তার মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাচ্ছে। গরিব মানুষকে সহায়তা করতে অর্থ, ওষুধসহ নানা উপকরণ দেয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় যেমন নকল বা ভেজাল ওষুধের সরবরাহ বাড়তে পারে; তেমনি করোনা প্রতিরোধী উপকরণ আমদানি করতে টাকা পাচারের মতো মানি লন্ডারিং অপরাধও ঘটতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, এফএটিএফের সতর্কবার্তা তারা পেয়েছেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও কাজ শুরু করেছে। এতে সহজেই যেকোনো ধরনের সঙ্কট কাটানো সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করেন।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বার্ষিক ১,২০০ অনলাইন ট্রানজেকশনের একটি এবং প্রতি ১০,০০০ অনলাইন ট্রানজেকশনকারীদের চারজনই ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির শিকার হন।
সময়ের সাথে একদিকে যেমন জীবন সহজ হচ্ছে, তেমন কঠিন হয়ে পড়ছে যাপনরীতি! দৈনন্দিন কেনাকাটা/লেনদেন সহজ করতে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড সরবরাহ করছে কিন্তু কোনোভাবেই প্রতিহত করা যাচ্ছে না এসব কার্ডের অপব্যবহার। শুধু কার্ড চুরি যাওয়াই না, কার্ড ব্যবহারের তথ্যও চুরি হয় এখন! হরহামেশা বাংলাদেশেও এখন এমনটা হচ্ছে।
জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রথম কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের বেশকিছু গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ‘কম্প্রোমাইজ’ করে তখন বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। ২০১৫ সালে রীতিমত পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিড়িক পড়ে যায় এমন জালিয়াতির ঘটনার। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ টাকা জালিয়াতির ধাক্কায় এমন কোনো ঘটনা আর প্রকাশ্যে না এলেও সামাজিক মাধ্যমে দুয়েকবার গুঞ্জন শোনা যায় হ্যাকিংয়ের।
জানেন কি- ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি কখন ঘটে? কোনো একটি ওয়েবসাইটে ঢুকে পছন্দসই পণ্য দেখে দাম পরিশোধের জন্য ‘পে নাও’ বাটন চাপামাত্রই আসলে সর্বনাশের শুরু হয়! তাই, যখন যেখান থেকেই ইন্টারনেট ব্রাউজ করেন না কেন মনে রাখবেন সাইটের নামের শুরুতে যদি যঃঃঢ়ং:// না থাকে তবে তাৎক্ষণিক ওই সাইট ত্যাগ করুন। যঃঃঢ়ং:// থাকা মানে ওই সাইটটি নিরাপদ, কিন্তু যদি কেবল যঃঃঢ়:// থাকে তবে ওই সাইট থেকে কিছু না কেনাই ভালো। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য।
মনের ভুলেও যদি মনে হয় যে আপনার কার্ডটি হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছেন না বা চুরি গেছে- দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যাংকের কার্ড তাঁদের কাস্টমার কেয়ার নম্বরে যোগাযোগ করুন। এখন সব ব্যাংকেরই ১৬২১৬ জাতীয় শর্টকোড আছে যেখানে যেকোনো নম্বর থেকেই কল করা যায়। আর, এসব কাস্টমার কেয়ার দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। বিশেষ করে কার্ড জালিয়াতি থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচাইতে বড় উপায় হচ্ছে সচেতনতা। টাকা তোলার জন্য যখন কোনো মেশিনে কার্ড দেবেন, আগে দেখে নিবেন বাড়তি কোনো যন্ত্র আবার তাতে সংযুক্ত নেই তো? কিংবা দোকানে গিয়ে কিছু কেনা বা অনলাইনে দাম পরিশোধের সময় টাকার পরিমাণ যাচাই করে নিবেন। পাশাপাশি, সবসময় নিরাপদ ও বহুল প্রচলিত ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা করাটাই বুদ্ধিমানের।
জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাবে স্বাভাবিক ব্যাংকিং ব্যাহত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহক অর্থের লেনদেন অনলাইনে করছে। অনলাইন লেনদেনে ব্যাংকগুলোতে তেমন তদারকি করা হয় না; যেমনটা করা হয় স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে। বিশেষ করে লেনদেনে অনলাইন নির্ভরতায় ডিজিটাল জালিয়াতি হওয়ার আশঙ্কা করছে এফএটিএফ। ইতোমধ্যে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে আন্তর্জাতিক জালিয়াতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও সতর্ক করা হয়েছিল ব্যাংকগুলোকে। সাইবার হ্যাকিং থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ব্যাংকগুলোও অনলাইন কার্যক্রমে সতর্ক হয়। বিশেষ করে এটিএম বুথগুলো সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। সাইবার হ্যাকিংয়ে গ্রাহকের অর্থ যাতে চুরি না হয়, সেজন্য ব্যাংকগুলোর আইটি খাতেও নজরদারি বাড়ানো হয়।
এটিএম বুথে দৈনিক লেনদেন ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা বন্ধ করে দেয়া হয়। কোনো ব্যাংক সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা, কোনো কোনো ব্যাংক রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা এটিএম বুথে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি এক ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে অন্য ব্যাংকের এটিএম কার্ডে লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়। রাশ টেনে ধরা হয় আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থের লেনদেনের।
বাস্তবতা হচ্ছে, সাইবার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে গোটা বাংলাদেশই রয়েছে। এই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে তা আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। শুধু আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানই বলছি কেন, তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট সব খাতে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ব্যবসায়ীরা সাইবার হামলার ঝুঁকিমুক্ত নন। তাই যেকোনো মূল্যে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাত মিলে এই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো অবকাশ নেই। তবে এ কথা ঠিক, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ, আর্থিক খাতে আইটির ব্যবহার হয়ে উঠেছে অতিমাত্রায় ব্যাপকভিত্তিক। সব ধরনের লেনদেনই এখন চলে ডিজিটাল সিস্টেমে। এর ফলে সময়ের সাথে ক্রমেই এই লেনদেন আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন আইটি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো- সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে। এই বিনিয়োগ হবে অবকাঠামো উন্নয়নসহ সফটওয়্যারের উন্নয়নের পেছনে। একই সাথে ব্যাংকারদের এ ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হতে হবে এবং নিতে হবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ।
লেখক : এম. শাহজাহান, সাংবাদিক