দেশের কৃষিজ পণ্য পরিবহন প্রায় পুরোপুরি সড়কপথের ওপর নির্ভরশীল। তাতে একদিকে যেমন পরিবহন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে পণ্য নষ্ট হওয়ার পরিমাণও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী দেশে কৃষিপণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় সড়কনির্ভরতার হার ৯৭ শতাংশেরও বেশি। দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টন শস্য উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের পণ্য বিপণনের মাত্রাও বাড়ছে। কৃষিজ ওসব পণ্য বিপণনে পরিবহনের প্রয়োজন হচ্ছে। আর যার প্রায় পুরোটাই সড়কপথে হচ্ছে। বিবিএস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সড়কপথে দেশের কৃষিপণ্য পরিবহন হচ্ছে ৯৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। নৌপথে পরিবহন হচ্ছে মাত্র ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর রেলপথে হচ্ছে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ। দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়কপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি খরচ পড়ে ১২ সেন্ট। তবে ৭ টনের বাহনে এ খরচ কমে সাড়ে ৯ সেন্টে আসে। অথচ ভারত ও পাকিস্তানে এ ব্যয় আড়াই সেন্টেরও কম। অর্থাৎ বাংলাদেশে সড়কপথে পণ্য পরিবহনে ব্যয় করতে হয় ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি।
সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলা থেকে প্রতিদিন সবজি ও কৃষিজ পণ্যবাহী কয়েক হাজার ট্রাক রাজধানীতে আসছে। ওসব ট্রাক রাস্তায় নানা ধরনের চাঁদা, ফেরিঘাটের যানজট, ভাঙাচোরা সড়ক পার হয়ে রাজধানীর বাজারে পৌঁছতে প্রায় একদিন সময় নিচ্ছে। তাতে পণ্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে পণ্য পরিবহন খরচও। যদিও রেল ও নৌপথ এ সংকট অনেকটাই কাটিয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যে তার নিদর্শনও মিলেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে পরিবহন ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে রেলপথ। পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় উত্তরের জেলাগুলো থেকে যখন রাজধানীতে ফল সরবরাহ প্রায় বন্ধের উপক্রম হচ্ছিল, তখন বিশেষ অবদান রাখে রেলপথ। উত্তরের জেলাগুলো থেকে ফল পরিবহনের জন্য ওই সময় বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা রাখা হয়। তাতে করোনাকালেও ফলের স্বাভাবিক ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পেয়েছে রাজধানীর বাসিন্দারা।
সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরের নৌপথের যোগাযোগও বেশ সক্রিয়। নৌপথে পরিবহন অনেক ক্ষেত্রেই কৃষিপণ্যের সঠিক মান ধরে রাখার ক্ষেত্রেও সহায়তা করে। কিন্তু ওই একই পণ্য সড়কপথে পরিবহনের ফলে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। মূলত উন্নত মাধ্যম ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই সড়ক থেকে বের হতে পারছে না কৃষিজ পণ্য পরিবহন। দেশের পণ্য পরিবহনসংক্রান্ত নীতি ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সড়কে এক ধরনের চরম অব্যবস্থাপনা চলছে। আবার পণ্য পরিবহনে নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও দেশে তা হয় খুবই সীমিত মাত্রায়। তাছাড়া সঠিক পরিবহন ব্যবস্থা যে শস্যের বহুমুখীকরণকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে, তা ইতিমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে। পাশাপাশি ভালো পরিবহন সুবিধায় ছোট ও ক্ষুদ্র কৃষকরা বেশি উপকৃত হয়। ফলে তাদের মধ্যে নতুন পণ্য উৎপাদন ও নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের আগ্রহ বাড়ে। মূলত এভাবেই শস্যের বহুমুখিতা বাড়ে। কিন্তু দেশে কৃষিপণ্য পরিবহনে সড়কনির্ভরতা এখন সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশে যেসব পণ্য পরিবহন হচ্ছে তার ২৫ শতাংশই শুধু সরাসরি কৃষিজ পণ্য। সড়কনির্ভরতায় ওসব পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ছে। বাংলাদেশে একটি ট্রাক ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার যেতে পারে। কিন্ত যানজট পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে এ গতি দ্বিগুণ করা গেলে লজিস্টিক ব্যয় ৭ থেকে ৩৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। আবার কৃষিজ পণ্য পরিবহন অন্য মাধ্যমে সরানো গেলেও যানজট কমার পাশাপাশি সড়কের মান ধরে রাখাও সম্ভব এবং কৃষিজ পণ্যের মান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভবও হতো। মূলত মানহীন পরিবহনের কারণেই কৃষিজ পণ্যের পোস্ট-হারভেস্ট লস বাড়ছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক জানান, দেশের সব ধরনের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সড়কনির্ভর হওয়ায় তা সড়ক-মহাসড়কের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। সড়কে যেমন বাড়তি যানজট তৈরি হচ্ছে, তেমনি সড়কও টিকছে কম। বেশির ভাগ পণ্যবাহী গাড়িই নির্ধারিত ওজনসীমার চেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন করছে। যা সড়ক-মহাসড়কের সীমাহীন ক্ষতি করছে। সেক্ষেত্রে কৃষিপণ্য পরিবহনে অন্য বিকল্প মাধ্যমগুলো বেশ সাশ্রয়ী ও পণ্যের টেকসই মানের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। তাতে সড়ক যেমন দীর্ঘস্থায়ী হবে, তেমনি রাস্তায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমে আসবে। তাছাড়া পরিবহন খাতে ফ্যাসিলিটেশনের নামে এখন চাঁদাবাজি বাড়ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক ফেডারেশনের সভাপতি মকবুল আহমেদ জানান, চাঁদাবাজির কারণেও পরিবহন খরচ অনেক বাড়ছে। প্রতিটি ট্রিপেই কোথাও না কোথাও চাঁদা দিতে হয়। নামে-বেনামে নানা সংগঠনকে চাঁদা না দিলে গাড়ি চলতে বাধা দেয়া হয়। এর পেছনে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা যেমন দায়ী, তেমনি পরিবহন চালক-মালিকরাও সমানভাবে দায়ী। যেসব গাড়ির রুট পারমিট কিংবা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক থাকে না সেগুলোতেই বেশি চাঁদাবাজি হয়। মালিক-চালকরা যদি সরকারের সব নিয়মনীতি অনুসরণ করে গাড়ি চালায় তাহলে এ চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে আসবে। পাশাপাশি যারা চাঁদা আদায় করছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
এ বিষয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জানান, মূলত তিনটি কারণে সড়কের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। প্রধানত দ্রুততম সময়ে পণ্য পৌঁছানো এবং গ্রামের সঙ্গে সড়কের একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ঠিক একই সময়ে অন্য দুটি মাধ্যম দ্রুত নিঃশেষ হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সড়কে যানজন ও খরচ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সময় এসেছে নৌপথ এবং রেলপথে পণ্য পরিবহনে ফির যাওয়ার। এক সময় দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। যা এখন ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। শুষ্ক মৌসুমে যা ৪ হাজারে নেমে আসে। শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনায় নৌপথকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ২৪টি নৌপথ নতুনভাবে তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ নৌপথেই স্বল্প খরচে এবং পরিবেশ সম্মতভাবে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব। পাশাপাশি রেলপথও পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হতে পারে। সেক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও কারিগরি উন্নয়ন করতে হবে।