মাদক নির্মূলে বদ্ধপরিকর সরকার। সেজন্য সাঁড়াসি অভিযানের পাশাপাশি ঢেলে সাজানো হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে ডোপ টেস্ট কার্যক্রমও। তাছাড়া সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় মাদক সেবনকারীদের চিহ্নিত করতেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকার সেজন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) আদলে একটি পৃথক প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রকল্প নিয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় 'মাদকাসক্ত শনাক্তকরণ ডোপ টেস্ট প্রবর্তন (প্রথম) পর্যায়' শীর্ষক ১৯ জেলায় ডোপ টেস্টের জন্য আলাদা বাংলাদেশ ড্রাগ টেস্টিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মাদকের মূলোৎপাটনে ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মাদক নির্মূলে যুক্ত সংস্থাগুলো মাঠে নামছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাদক পাচার ঠেকাতে নতুন তালিকা করে আরো কঠোর অভিযান চালাবে। ড্রাগ টেস্টিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে সরকারি চাকরি ছাড়াও বেসরকারি চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তি এবং প্রয়োজনে রাজনৈতিক পদপ্রত্যাশীদেরও ডোপ টেস্ট করানো হবে। শুধু চাকরির আগেই নয়, চাকরিতে যোগদান বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির পরও শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট করানো হবে। তাছাড়া ইনস্টিটিউট সন্দেহভাজন যে কাউকেই ডোপ টেস্ট করিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সূত্রটি জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সব স্তরের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে ডোপ টেস্ট' অন্তর্ভুক্তকরণ-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল। আর সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে ওই বছরই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেয়া হয়। তাছাড়া উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির আগে এবং চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে ডোপ টেস্ট বা বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছিল। গত আগস্টে ওই চিঠির বাস্তবায়নের অগ্রগতি না পাওয়ায় সংশ্নিষ্ট বিভাগে তাগিদপত্র দেয়া হয়। তবে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে চলতি বছরের ২৪ জুন তাদের আওতাধীন দপ্তরগুলোতে ওই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত শুধু পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্টের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ডোপ টেস্ট কার্যক্রম জোরদার করতে ৬২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ বছর মেয়াদি মাদকাসক্ত শনাক্তকরণ ও ডোপ টেস্ট প্রবর্তন (প্রথম) পর্যায় শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়েছে। তা পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, যশোর, কুমিল্লা, রাঙামাটি, নোয়াখালী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, দিনাজপুর ও রংপুর- ওই ১৯ জেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। মাদক নির্মূলের পাশাপাশি মাদকসেবীদের সুস্থ জীবনে ফেরানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় পুলিশ কমিশনার প্রতিটি থানার ওসিকে নিজ নিজ এলাকায় মাদকাসক্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। মাদকসেবীদের চিহ্নিত করে তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পুনর্বাসনে সহায়তারও নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রয়োজনে মাদকসেবীকে সংশোধনাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন। তারপরও কেউ সংশোধন না হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
এদিকে মাদক নির্মূলের শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সন্দেহভাজন সদস্যদেরও ডোপ টেস্ট করানো হচ্ছে। ডিএমপির অন্তত ১০০ সন্দেহভাজন সদস্যের মধ্যে ২৬ জনের পজিটিভ পাওয়ায় তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুধু ডিএমপিতেই নয়, পুলিশের সব ইউনিটে গোপনে ডোপ টেস্ট কার্যক্রম চলবে। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকাও হালনাগাদ করতে সারাদেশের পুলিশ ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশের কোনো সদস্য যাতে মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত না হয়, মাদক সেবন করতে না পারে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে না পারে, সেজন্য সব সময় কড়া নজরদারির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশে চাকরির আগে যেমন ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে, তেমনি চাকরিতে যোগদানের পরও করা হচ্ছে।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও দেশব্যাপী মাদক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরো গতিশীল ও জোরদার করতে বিএসটিআইয়ের আদলে একটি পৃথক ইনস্টিটিউট গঠনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কমিটির আলোচনায় বলা হয়, মাদক নির্মূল শুধু অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নানা পরিকল্পনা নিয়ে এই যুদ্ধ চলছে। ইতিমধ্যে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ডোপ টেস্ট বা বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জোর দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে এবং তা আরো জোরদার করা হয়েছে। তাছাড়া মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন, স্থানীয় জনতা, ছাত্র-শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু জানান, মাদক শনাক্তের ভয় থাকলে সবাই মাদক থেকে দূরে থাকবে। তাই বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা ডোপ টেস্ট কার্যক্রম জোরদারের জন্য স্থায়ী কমিটি থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে।