শিকার হচ্ছে দেশের শিশু কিশোরসহ তরুণ সমাজ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা সামাজিক মূল্যবোধের অবনতি হচ্ছে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বরাবরই ছিলাম অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো। বাংলাদেশের রুট লেভেল থেকে শুরু করে হায়ার লেভেল পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে অন্যায় আর অপরাধের রামরাজত্ব। মুক্তির কোন পথ তৈরির চেষ্টা করছে না কেউ। এমন কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টাও ব্যহত হচ্ছে সচিব-মন্ত্রীদের অবহেলার কারণে। পাশাপাশি প্রশাসনেও চলছে অপরাধের রাজত্ব নির্মাণের চেষ্টা।
যারা ফেসবুক-টুইটার সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কি নেই এখন! রকেট সায়েন্স কোয়ান্টাম ফিজিক্স কিংবা জিন টেকনোলজি? যা চান সব পাওয়া যায় এখানে। রাতারাতি তারকাখ্যাতি এবং নগদ অর্থসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রচার-প্রসারে সক্ষম এসব মাধ্যম। তবে উল্টো পিঠেই চলছে বিনোদনের নামে প্ররোচণামূলক আপত্তিকর সব অশ্লীল ভিডিও ও অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে- এমন সব কন্টেন্ট। একটা গোষ্ঠীর অনৈতিক অর্থ আয়ের সহজলভ্য শিকার হচ্ছে দেশের শিশু কিশোরসহ পুরো তরুণ সমাজ। আর কোনো কিছু না বুঝে অজান্তেই এই ফাঁদে পা দিচ্ছে একটি বড় অংশ। যারা ফাঁদে পা দিচ্ছে, তাদেরকে উদ্ধারের চেষ্টাটি চালিয়ে যেতে তৈরি আমি-আমার লেখনি-নতুনধারার রাজনৈতিক চেষ্টাও।
আমি মনে করি এভাবে বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যে অনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে, তা থামাতে এখনই উদ্যেগ নিতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সাহস-সুন্দর-সাহসের সাথে। এখন কথায় কথায় যা হচ্ছে, তা হলো- টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে বানানো এসব ভিডিও মূলত বিভিন্ন অপরাধ, দ্বন্দ্ব, মাদক ও যৌনতা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। আর এতেই দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এসব অনলাইন প্লাটফর্ম। বর্তমানে ইউটিউবের পাশাপাশি এখন ইমু, টিকটক, লাইকলি, স্ন্যাপ চ্যাটসহ ফেসবুকের মতো ওয়েব সাইটগুলোতে নগ্ন-অর্ধনগ্ন এমনকি কোনো কোনো সাইটে ৩ থেকে ৪ মিনিটের পর্নো ভিডিও ক্লিপও চলছে নানা মোড়কে। এছাড়াও কন্টেন্ট দেখে অনেকেই প্রক্রিয়া শিখে সহজলভ্য আয়ের লোভে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে কিশোর গ্যাং কালচারের অন্যতম উদাহরণ বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষকরা।
অনেকেই এখন বিভিন্ন অ্যাপসে প্রবেশ করলেই অসংখ্য আইডি দেখতে পান। এসব আইডির প্রোফাইলে দেওয়া থাকে আপত্তিকর ছবি। শুধু তাই নয়, আইডি থেকে প্রতিদিনই পাঠানো হয় ক্ষুদে বার্তা। যাতে লেখা থাকে প্রলোভন জাতীয় শব্দ-বাক্য। যেমন- জাকির তুমি কি সিঙ্গেল?' অবার লেখা থাকে- 'তুমি যা চাও সব পাবে! আমি তোমার অপেক্ষায়!' কিন্তু এই অ্যাপসটি দিয়ে তার ১১ বছর বয়সি মেয়ে সহ পরিবারের সবাই আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন। এসব বার্তা ও ছবির কারণে প্রায় সময় পরিবারের সদস্যদের কাছে তিনি বিব্রত হচ্ছেন। কৌতুহলবশত বড়দের অনুপস্থিতিতে ছোটরা এসব কন্টেন্ট দেখতে পারে এবং অনৈতিক কর্মকান্ডে উৎসাহ পেতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে শুধু কি ইমু আর ভাইবার? এই পালে সর্বশেষ সংযোজন বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ২০১৭ সালে সংস্থাটি তাদের সাইটে ভিডিও আপলোড ও দেখার বিশেষ সুবিধা চালু করে। যথারীতি এখানেও পর্নো ক্লিপসহ ওয়েব সিরিজের নামে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আপত্তিকর কন্টেন্টের মহাউৎসব চলছে। এই উৎসবে বাংলাদেশের রাজনীতির বারোটা যেমন বেজেছে, বেজেছে বারোটা শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও ধর্মীয় অঙ্গণের। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, চলমান ফেসবুকে ভিডিও সুবিধা চালু হওয়ার পর থেকে এই প্লাটফর্মটি সামাজিক যোগাযোগের চেয়ে ভিডিও দেখায় বেশি সময় ব্যয় করছেন তারা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ বয়স্ক, এমনকি শিশুরা- যাদের ফেসবুক আইডি নেই তারাও পরিবারের বড়দের মোবাইল থেকে এসব ভিডিও দেখছেন। আর এই ভিডিও অপশনে ধারাবাহিকভাবে গান, সিনেমা, বিভিন্ন ঘটনা থেকে শুরু করে খুন, হাইজ্যাক ও পর্নো সবই স্ক্রিনে আসতে থাকে। দেখা যায়, আপনি আগ্রহী নন, তবুও এমন সব কন্টেন্ট চলে আসবে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই মাধ্যমের এমন কন্টেন্টের কারণে সর্বস্তরে সামাজিক মূল্যবোধের অবনতির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
খেয়াল করলে দেখা যাবে বেশ কয়েকে বছর ধরেই মূলধারার গণমাধ্যম ছাপিয়ে আলোচনায় অল্টারনেটিভ অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে যখন দেশের মূলধারার গণমাধ্যম দর্শক ও পাঠক স্বল্পতায় ভুগছে, তখন ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের মতো মাধ্যমের এক বা দুই মিনিটের একটা কন্টেন্ট কয়েক লাখ দর্শক দেখে নিচ্ছেন। আবার দিন শেষে এসব মাধমে ভাইরাল হওয়া বিষয়ই মূলধারার গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে।
অনেকের মত আমিও বলতে পারি- বর্তমান সময়ে তরুণদের সাফল্য ও অবক্ষয় দুটোতেই এসব মাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহারে ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকায় তা আপাদমস্তক বদলে দিয়েছে গণমাধ্যমের সব বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশও। এখন একজন ব্যক্তিই 'গণমাধ্যমে' রূপ নিয়েছে। এসব ব্যক্তি নিয়ন্ত্র্ত্রিত মাধ্যম মত প্রকাশ ও চিন্তা স্বাধীনতার নতুন দিগন্ত খুলে দিলেও দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা না থাকায় নেতিবাচক দিকটা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত কষ্টসময় পেনডামিক পরিস্থিতি করোনাতেও দিন শেষে আমরা কি নিয়ে আলোচনা করব তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমই নির্দিষ্ট করে দেয়। এছাড়া এসব মাধ্যমের ব্যক্তি চিন্তার গতিপথও নির্ধারণ করার শক্তি রয়েছে। সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ নীতিহীন মন্ত্রী-মন্ত্রণালয়-সচিব-সংসদীয় কমিটির দায় সাড়া গোছের নীতিমালা-কর্মকান্ড। বর্তমান সময়ে এমন কোনো সিস্টেম নেই যা দিয়ে কোনো কিছু আটকে রাখা যায়। তাই কঠোর নীতিমালা কিংবা ওয়েব সাইটগুলো বন্ধ করে কিছুই সমাধান হবে না বরং তা বিপক্ষেই যাবে। এটা ঠিক যে টিনএজাররা এসব মাধ্যম দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। তাদের মধ্যে নিজেকে নিয়ে হতাশা তৈরি হয়। এসব মাধ্যম ব্যবহারের ফলে ছেলে-মেয়ে উভয়ই তাদের শারীরিক গঠন নিয়ে হতাশায় ভোগে, যখন তার স্তরেই অন্য কেউ তার থেকে নিজেকে বেশি আবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপন করে। আর এসব নিয়ে তাদের মধ্যে (টিনএজাররা) এক ধরনের প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়। যা তাদের অনৈতিক কর্মকান্ডের উৎস। এছাড়াও যৌন শিক্ষায় দেশের নীতি নির্ধারকদের প্রচন্ড লজ্জা থাকায় কৌতূহল বসত এসব কন্টেন্টের ফাঁদে কিশোর-কিশোরীরা আটকে যাচ্ছে।
শুধু পর্ণই নয়; ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবেও চলছে অন্যায়-অপরাধ ছড়ানোর কন্টেন্ট। কন্টেন্টের বিরুদ্ধে আপনাকে-আমাকে কন্টেন্ট দিয়েই লড়তে হবে। অনলাইনসহ সব ধরনের মাধ্যমে ক্রিয়েটিভ ও কোয়ালিটি সম্পূর্ণ কোনো কিছুই নেই যা মানুষের আগ্রহ বাড়াবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারে বড়দের জীবন দর্শন ও চর্চা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মা কিংবা বাবাকে শিশু-কিশোররা অনুকরণ করে। কিন্তু অধিকাংশ মা-বাবাই এখন সোস্যাল মিডিয়ার আসক্ত। এ থেকে উত্তরণে প্রকৃত ধর্ম-মানবতা-সভ্যতার জন্য নিবেদিত থেকে এগিয়ে চলার কোন বিকল্প নেই।
একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে জেনেছি- ইউনিভার্সিটি অব পেনসেলভানিয়ার একদল গবেষক শিশু-কিশোরদের মনোজগতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কন্টেন্টের নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। আশার কথা হলো- ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জোকারবার্গের মেসেঞ্জার কিডস নামে বাচ্চাদের মেসেজিং অ্যাপটি বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধও জানান এই গবেষকরা।
এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা অন্ধকারে শিশু-কিশোদের অনলাইন প্লাটফর্মগুলো ব্যবহারে সতর্ক না হলে সামাজিক অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। ১৬ বছরের কম বয়সিদের এসব মিডিয়ার ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি। কেননা, সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন আপত্তিকর কন্টেন্ট কিশোর-কিশোরীদের মানসিকতায় অস্বাভাবিক সব পরিবর্তন এনে দিচ্ছে। ফলে ছেলে-মেয়ে উভয়ের দৈহিক ভাষার অস্বাভাবিক পরিবর্তনসহ অতিমাত্রায় এডরিন্যাল হ্রাস করছে। যা তাদের বিপজ্জনক কর্মকান্ডে প্ররোচিত করছে। ১৪ থেকে ২০ বছরের অনেক রোগী পেয়েছেন যারা নিজেরাই তাদের হাত-পা এমনকি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধারালো বস্তু দিয়ে কেটেছে। শুধু তাই নয়, আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল। সাধারণত এসব রোগীদের চিকিৎসায় ডিপ্রেশন কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলার পর তিনি দেখলেন, সামাজিক মাধ্যমের বেশি ব্যবহারে ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাবে তারা এমনটা করছেন।
২০১৭ সালে রয়্যাল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ ১১ থেকে ১৫ বছরের দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনমন্যতা এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করছে। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছে- ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের দেহ নিয়ে অসন্তুষ্ট। ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোর-কিশোরীদের অর্ধেকই বলেছে, ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও অশান্তি বেড়ে গেছে। দু-তৃতীয়াংশ ফেসবুকের কারণে সাইবার অপরাধ করার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ার কারণে ফোন নিয়ে খুব বেশি সময় যারা ব্যয় করছেন তারা এক ধরনের কল্পনার জগত বা প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে বিরাজ করছেন। এই জগৎটার সঙ্গে বাস্তবের মিল না হলেই নানা ধরনের দুর্ঘটনা তারা ঘটিয়ে ফেলেন এবং ডিপ্রেশনে ভোগেন। এতে করে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিদিনই অবনতি ঘটে। সে নিরিখে এসব রোগীদের চিকিৎসায় তিনি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই রোগীদের অবস্থা লক্ষণীয়ভাবে ভালো হয়েছে। বিশেষ করে পারিবারিকভাবে যথাযথ যৌন শিক্ষা দিলে এ ঝুঁকি থেকে অনেকটাই তরুণদের মুক্তি মিলবে। ইতোমধ্যেই অনেক দেশে স্ন্যাপ চ্যাট, ইমু, টিকটকসহ এ ধরনের অ্যাপসের উপর কড়াকড়ি আরোপ এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ধর্ষণ-নারী-নির্যাতন-খুন-গুমের প্রবণতা তৈরির পেছনেও রয়েছে অন্ধকারের অনলাইন চর্চা। রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের খারাপ দিক। চাই-উত্তরণে সরকারের সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় অগ্রসর হওয়া আর সবচেয়ে বড় এই সমস্যা সমাধানে নিবেদিত থেকে কাজ করে যাওয়া...
¬¬
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, অনলাইন প্রেস ইউনিটি