যে বিজয় ভারতে হাত ধরে-আন্তরিকতায় এসেছে, সে বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়ন সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে জাহিদুল ইসলাম নামের এক যুবক নিহত হন। বিএসএফ সূত্রের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছে- নদীয়ার পাকুড়িয়া বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট) এলাকায় কাঁটাতার কেটে ভারতের ঢোকার চেষ্টা করছিল বেশ কয়েক জন। বিষয়টি নজরে আসার পর বিএসএফ শূন্যে গুলি চালিয়ে তাদের সতর্ক করে। কিন্তু এরপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গুলি চালায় বিএসএফ। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক নারী পড়ে রয়েছে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বগুলা হাসপাতাল ও পরে কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিএসএফ জানিয়েছে, নিহত নারীর নাম সাহরন হালদার (৪৫)। তিনি বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাসিন্দা। এ ঘটনায় হাঁসখালী থানায় বিএসএফের পক্ষ থেকে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আমাদের পররাষ্ট্র-স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু তাতেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? যায় না, তাই চাই স্থায়ি সমাধান-নিরাপদ দেশ-সীমান্ত।
স্বাধীনতার পর থেকে যেভাবে বাংলাদেশীদেরকে একের পর এক কোন এক অজানা কারণে নির্মমভাবে হত্যা করছে ছাত্র-যুব-জনতাকে। এখান থেকে উত্তরণে নিবেদিত থাকতে হবে সবাইকে। কেননা, সবাইকে কষ্ট দেয়ার বিষয়টি হলো- সরকারি হিসাবে এক বছরে সীমান্ত হত্যা ১২ গুণ বেড়েছে। নানা প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা কমছে না। আর গত তিন বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যা হয়েছে গত বছর। সর্বশেষ দিল্লীতে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বৈঠকের পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর সীমান্তে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বিএসএফ-এর গুলিতে। আহত হয়েছেন দুই জন। তখন ভারতীয় চাঁদনী চক ক্যাম্পের টিকলীরচর এলাকায় বিএসএফ সদস্যরা গুলি করলে সেলিম ও সুমন নামে দুই বাংলাদেশি নিহত হন। সাকির ও লালবর আহত হন। সহযোগীরা নিহতদের লাশ ও আহতদের বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। গত ২৫ থেকে ৩০ ডিসেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন হয়। সেখানে হত্যা কমিয়ে আনা নিয়েও আলোচনা হয়। বাংলাদেশ থেকে বিজিবি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল এবং ভারতের বিএসএফ মহাপরিচালক শ্রী বিবেক জোহরীর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল ওই সম্মেলনে অংশ নেয়। কিন্তু তাতেও কিছু যায় আসেনি, পরিবর্তন হয়নি বর্ডারের চিত্রেরও। ২০১৯ সালে সীমান্তে ৩৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। কিন্তু বিএসএফ-এর হিসেবে এই সংখ্যা আরো কম। আর সরকারি হিসেবে ২০১৮ সালে সীমান্তে তিনজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে ১৭ জন। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয় জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। আর ২০১৭ সালে ২৪ জন। সরকারি হিসাব ধরলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে ১২ গুণ। আর বেসরকারি হিসাবে তিনগুণের বেশি। সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি শুধু সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়েই রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকেও দেয়া হয়েছে। সীমান্তে প্রাণঘাতী বা ‘লিথাল উইপন' ব্যাবহার না করার ব্যাপারেও দুই দেশ প্রতিশ্রুতবদ্ধ। ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঢাকায় দুই দেশের সীমান্ত সম্মেলনেও এই সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়। কিন্তু তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না। সীমন্তে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বাড়ছেই। তবে ভাবনার বিষয় হলো- আগে বিএসএফ বলতো আমাদের ওপর আক্রমণ করতে এলে আমরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছি। লাশ ফেরত দিতো। এখন আর তাও বলেনা। গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। ফেরতও দেয় না। বলা হচ্ছে- ভারত তো একটা হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা তো সীমান্ত হত্যা বন্ধ করবেনা। সীমান্তে মুসলমানদের মারছে। আর ঠেলে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। আমরা প্রতিটি ঘটনার প্রতিবাদ করছি। কিন্তু ভারত হত্যা করবেই সে থামবে না। তারা মারছে তো মারছেই। কিন্তু বাংলাদেশের দিক দিয়ে শক্ত কোনো প্রতিবাদ দেখতে পাচ্ছিনা। মেরে দিচ্ছে কোনো বিচার নাই। ইতিহাস বলছে- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় ছিল ভারত। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে বাঙ্গালীদের জন্য খুলে দেয়া হয় দেশটির সীমান্ত। নভেম্বরে গঠন হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড, যার পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যত মানুষকে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ হত্যা করে তার ৮০ ভাগ বাংলাদেশী। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্ডার এলাকার। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে কোন সরকারই এর প্রতিবাদ করেনি; বর্তমান সরকারও এনিয়ে শক্ত কোনো প্রতিবাদ করছেনা। কেউ কেউ অবশ্য বলছে যে, সীমান্ত হত্যা আবার বেড়ে যাওয়ার পিছনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণ আছে। আর দুই দেশেই এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেটা গড়ে ওঠেনি। ভারত বলছে। আমরাও বলছি। একথাটাও ভিত্তিহীন নয় যে, নতজানু রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে সীমান্ত হত্যাকান্ড বন্ধ হচ্ছে না। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে যেহেতু এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যাওয়ারও সুযোগ রাখে, কেন তা করা হচ্ছে না; আমার বুঝে আসে না। তাছাড়া সীমান্ত হত্যা বন্ধে ২০১১ সালে বিজিবি ও ভারতের বিএসএফের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয়, সীমান্ত পারাপারে মানুষ হত্যায় অস্ত্র ব্যবহার করবে না এই দুটি দেশ। চুক্তি করেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা।
এমন একটি পরিস্থিতিতে মনে পড়ে যাচ্ছে- জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন- গত ১০ বছরে সীমান্তে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ ও ২০১৮ সালে ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে।’ আর পরের দুই বছর? পরের দুই বছরে মানবাধিকার বাংলাদেশ-এর তথ্যনুযায়ী ১১৮ জনকে হত্যা করার তথ্য দিচ্ছে।
একটু গভীরভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যার রহস্য উন্মোচন নিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে- যেসব সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল আনা-নেয়া হচ্ছে সেখানে তো সীমান্তরক্ষীর বাহিনীর গুলিতে কেউ মারা যাচ্ছে না। আবার মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনা-নেয়ার সময়ও গুলিতে কেউ মরছে না। শুধু এখানেই শেষ নয়; যেসব সীমান্ত দিয়ে গরু আনা হচ্ছে সেখানেই মানুষ মারা যাচ্ছেন। এখন তো গরু চোরাচালান অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। তারপরও কেন সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামছে না? আমরা তো এর আগে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধানদের বলতে শুনেছি, গুলিতে যে মারা গেছে সে গরু চোরাকারবারি। অথচ আমরা আমাদের গ্রামে ঢুকে তাদের মারতে দেখেছি। এখন ওরা বড় দেশ। আমরা অনেক ছোট। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় পলিসি তো শক্ত হতে হবে। নতজানু পলিসির কারণে আমরা এটা বন্ধ করতে পারছি না। আমরা তো প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। চাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে; তাই বলে একের পর এক মৃত্যু? না! এ অন্যায় মেনে নেয়ার মত অত মানষিক শক্তি অন্তত আমার নেই।
একবারের কথা বলছি, সেবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সদ্য মৃত্যুবরণকারী রাজনীতিক সাহারা খাতুন। তিনি অত্যান্ত স্নেহ করতেন আমাকে। সেই সুবাদে দেশে এবং দেশের বাইরের তাঁর বিভিন্ন মিটিং সম্পর্কে ছিলো আমার কাছে অনেক তথ্য। জানতাম তিনি কবে কোথায় কোন মিটিং-এ যাচ্ছেন, তাও। একবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে তাঁর মন কেঁদে ওঠে। বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় দিল্লিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের সঙ্গে বৈঠক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকান্ড অনেক কমেছে বলে দাবি করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ আর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন তার এই বক্তব্য শুনে সীমান্তে হত্যা ‘শূন্যে' নামিয়ে আনতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান এবং বলেন, আমি সীমান্ত হত্যা কম নয়; একদমই চাই না। এখন প্রশ্ন হলো- দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, তাহলে গ্যাপটা কোথায়? সেটা আসলে আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। একটা হতে পারে আমরা ছোট দেশ, আর ওরা বড় দেশ। এ কারণে ওরা আমাদের কথা গুরুত্বই দিচ্ছে না। এই কারণে আমি বলি, আলোচনাটা আরো বাড়াতে হবে। শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলতে হবে। পাশাপাশি সমাধানকল্পে রাষ্ট্রিয় চুক্তিতে যেতে হবে; যাতে করে সীমান্ত হয় নিরাপদ। বিশেষ কোন কারণে যদি হত্যাকান্ড হয়, সেই সমস্যাগুলো নিবারণ করার উদ্যোগ নিতে হবে দুই পক্ষকেই৷ এটাতো কারোর একার ব্যাপার না। আমাদের মানুষ মারা যাচ্ছে, ওরা মারছে, ইন-বিটুইন নিশ্চয় কোনো গ্যাপ আছে, ইনফরেমশন গ্যাপ আছে- এই গ্যাপটা জানা উচিত এবং নিরীহ মানুষের মৃত্যুটা বন্ধ করা উচিত বলেই আমি মনে করি। রাজপথে থাকি-কাজপথে থাকি বলেই কোন নারী-পুরুষের মৃত্যু সহ্য করতে পারি না। মনে যেন নিজেকেই নিজে জবাই করছি এই অন্যায় মেনে নিয়ে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি