যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কপালিয়া বাজারের খেয়াঘাট, উলুরডাঙ্গী ও কালকেতলা নামক স্থানে ২১ শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে গণকবর (বদ্ধভূমি) সংরক্ষনের জন্য এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শহীদদের স্মরণে দুইটি গণকবর সংরক্ষন করে সেখানে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের জন্য স্থানীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাবেক হুইপ অধ্যক্ষ শেখ আবদুল ওহাব ভিত্তিপ্রস্থর উদ্বোধন করেন। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবে রুপ নেয়নি বা আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে ভিত্তিপ্রস্থরটি অযতেœ অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে দুটি সংগঠনের কার্য্যালয় ও একটি চায়ের দোকান।
এলাকা সরেজমিনে জানাযায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন সময় মুুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ ও আশ্রয় দেয়াসহ বিভিন্ন সহযোগীতা করার কারণে ১১ আগস্ট রাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকহানাদান বাহিনীর হাতে মণিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের আটজন এবং পশ্চিম কপালিয়ার একজন মুক্তিকামী যুবককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে উলুরডাঙ্গী ও কালকেতলা নামক স্থানে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফাঁয়ারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যার পর হানাদারেরা সেখানে একটি গর্ত করে আট শহীদকে একসাথে মাটি চাপা দেয় এবং একজনকে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়। শহীদরা হলেন, মশিয়ার রহমান, শওকত আলী, মনোহরপুরের জয়নাল আলী, আতিয়ার রহমান, গোলাম সরোয়ার, আকবর হোসেন, সোহরাব বিশ্বাষ এবং নড়াইল জেলার কালিয়ার আতিয়ার রহমান ও পশ্চিম কপালিয়ার ফুলটনি।
এছাড়া একই অভিযোগে হানাদারেরা ৫ অক্টোবর রাতে কাপালীয়ার ৪১ জন যুককে ধরে নিয়ে যায় কপালিয়া খেয়া ঘাটের পাড়ে (বর্তমানে সেখানে কপালীয়া ব্রীজ)। এদের মধ্যে মুুক্তিকামী ১২ জন যুবকে আটকে রেখে বাকীদের মারপিট করে ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তিতে ওই রাতেই ১২ জনের চোখ বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে শরীরে খুুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্তের পর ক্ষত স্থানে লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে তাদেরকেও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে নদীর পাড়ে। সেখানে একটি গর্ত খুড়ে মাটি চাপা দেয় হানাদার বাহিনীর দল। এখানকার ১২ শহীদরা হলেন, বিভিন্ন এলাকার ফজলুর রহমান, গোলজার হোসেন, আবদুস সামাদ, আনছার আলী, ওয়াজেদ আলী, জোনাব আলী, ঠাকুর দাস, চিত্ত রঞ্জন, মনোরঞ্জন, নূর মোহাম্মদ, ইকবাল হোসেন এবং রাজেস্বর।
তিনটি স্থানে ১৯৭১ সালের আগস্ট ও অক্টোবর মাসে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছিলেন এলাকার ২১ সূর্য সন্তান। স্বাধীনতার ৪০ পর ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে কপালিয়া ব্রীজের উপর এক আলোচনা সভা শেষে জাতীয় সংসদের তৎকালীন হুইপ অধ্যক্ষ শেখ আবদুল ওহাব ভিত্তিপ্রস্থর উদ্বোধন করেন। এ সময় তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলেন মণিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বর্তমান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বর্তমান নগর সম্পাদক মধুসূদন মন্ডল, বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মশিউর রহমান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কালিপদ বিশ্বাসসহ আরও অনেকে। দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত সেখানে কোন স্মতি স্তম্ভ নির্মাণ হয়নি। বর্তমানে ভিত্তিপ্রস্থরটি অযতেœ অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
ভিত্তিপ্রস্থরটিকে ঘিরে ফেলানো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পরিত্যক্ত বর্জ্য জিনিসপত্র। তার উত্তর পাশে গড়ে উঠেছে দুটি সংগঠনের কার্য্যালয় ও একটি চায়ের দোকান। কার্য্যালয় দু’টি হচ্ছে মনোহরপুর ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক কার্য্যালয় ও আরেকটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কার্য্যালয় এবং অপরটি হচ্ছে দিলিপ সাহার চায়ের দোকান। এলাকাবাসী এসব শহীদদের স্মৃতি রক্ষা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর মনোহরপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি রক্ষা পরিষদের ব্যানারে ৯ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন স্থানীয় মনোহরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বি.এম মোস্তফা মহিতুজ্জামান এবং কপালীয়া খেয়া ঘাটের তীরে হানাদারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মোহাম্মদ আলী সরদার ছিলেন সদস্য সচিব।
পাকহানাদারদের হাতে নির্মম নিহত শহীদদের উদ্ধারকারী প্রত্যক্ষদর্শী ও মনোহরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কপালিয়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাস বলেন, ঘটনার রাতে হত্যা করা ২১ জনের মধ্যে ১৮ শহীদের মৃতদেহ উদ্ধার করা গেলেও বাকি ৩ জনের মরদেহ ছিলো নিখোঁজ। এসব শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এলাকার কৃতী সন্তান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সিটি এডিটর সাংবাদিক মধুসুদন মন্ডলের পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা তাদের স্মরণে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের ভূমিকা নিয়েছিলাম। ভিত্তিপ্রস্থরটি উদ্বোধন করাতে সক্ষম হলেও কালের আবর্তনে বাকি কাজটি শেষ নামানো সম্ভম হয়নি। এরপরও আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি শহীদদের স্মৃতি রক্ষা করার জন্য।
সাবেক সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলীর সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পরিবার রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ কপালীয়ার ২১ শহীদের নামটি আজও পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়নি। এমনকি তাদের সন্তানদের মধ্যে অনেকেই বর্তমান ভ্যান চালিয়ে এবং দিন মজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। আর স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্থরটি আজ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এগুলো দেখার কেউ নেই ?
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, আমি মণিরামপুর উপজেলায় যোগদান করেছি অল্পদিন হচ্ছে। বিষয়টি যতদ্রুত সম্ভব খোঁজ-খবর নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিটক শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।